আজকে গ্যাসের ওষুধ খেয়েছেন? পেটে গ্যাস কমাতে আমাদের দেশে প্রায় প্রতিদিন বিনা প্রয়োজনে কোটি কোটি টাকার ঔষুধ খাচ্ছে মানুষ। বাংলাদেশে এসব ঔষুধ সার্জেল, মাক্সপ্রো, প্যান্টোনিক্স ইত্যাদি নামে বহুল পরিচিত। অনেকে এগুলোকে গ্যাসের বড়ি নামেও ডাকেন।গ্যাস্ট্রিক আলসার, অ্যাসিড রিফ্লাক্স এবং অন্যান্য পেটের সমস্যায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। যদিও এই ওষুধগুলি অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর, তবে অতিরিক্ত এবং দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
২০২৪ এর প্রথম ৯ মাসে ওমিপ্রাজল, ইসমোপ্রাজল ও প্রেন্টাপ্রাজল জেনেরিক গ্রুপভুক্ত তিনটি ব্র্যান্ডের ওষুধ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৭৮০ কোটি টাকার। দেশের মোট ওষুধের বাজারের বড় অংশই দখল করে আছে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ। গত অর্থবছরে দেশের বাজারে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকার গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বিক্রি হয় ৭০ শতাংশ গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করা হয় অপ্রয়োজনে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই।সূত্রঃ আইএমএস হেলথ
গ্যাসের ঔষুধ কিভাবে কাজ করে?
এসব ওষুধ পাকস্থলীর কোষগুলিতে অ্যাসিড তৈরির পাম্পগুলিকে বন্ধ করে দেয়। এর ফলে পাকস্থলীতে অ্যাসিডের পরিমাণ কমে যায়, যা আলসার এবং অ্যাসিড রিফ্লাক্সের চিকিৎসায় সাহায্য করে। এই ওষুধগুলি সাধারণত নিরাপদ এবং কার্যকর হিসাবে বিবেচিত হয়, তবে অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে কিছু গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে।
অতিরিক্ত সেবনের ক্ষতিকর প্রভাব:
১. ভিটামিন এবং খনিজ অভাব:
পিপিআই দীর্ঘকাল ধরে সেবন করলে ভিটামিন বি১২, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং আয়রনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন এবং খনিজগুলির শোষণ কমে যেতে পারে। ভিটামিন বি১২-এর অভাবে রক্তশূন্যতা এবং স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে। ক্যালসিয়ামের অভাব হাড়ের দুর্বলতা এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়। ম্যাগনেসিয়ামের অভাব হৃদরোগ এবং পেশীর দুর্বলতার কারণ হতে পারে।
২. হাড়ের দুর্বলতা:
গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা দীর্ঘকাল ধরে পিপিআই সেবন করেন, তাদের হাড় ভাঙার ঝুঁকি বেড়ে যায় । বিশেষ করে বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে হিপ ফ্র্যাকচারের সম্ভাবনা বেশি থাকে। পিপিআই ক্যালসিয়াম শোষণে বাধা দেয়, যা হাড়ের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়।
৩. পেটের সংক্রমণ:
পিপিআই পাকস্থলীর অ্যাসিড কমিয়ে দেওয়ায় ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে । Clostridium difficile নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ডায়রিয়া এবং পেটের অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও, অন্যান্য খাদ্যবাহিত রোগ হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
৪. কিডনির সমস্যা:
দীর্ঘমেয়াদী পিপিআই ব্যবহারের ফলে কিডনির রোগ হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে । কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, পিপিআই সেবনকারীদের মধ্যে অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি (AKI) এবং ক্রনিক কিডনি ডিজিজের (CKD) ঘটনা বেশি ঘটে।
৫. হৃদরোগের ঝুঁকি:
কিছু গবেষণা অনুযায়ী, পিপিআই সেবন হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে । যদিও এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন, তবে কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে যে পিপিআই রক্তনালীর কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে, যা হৃদরোগের কারণ হতে পারে।
৬. ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ:
কিছু গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে, পিপিআই-এর দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশের ঝুঁকি বাড়াতে পারে । যদিও এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন, তবে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উপর পিপিআই-এর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
করণীয়:
-
চিকিৎসকের পরামর্শ: পিপিআই সেবন করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
-
ডোজ মেনে চলুন: ডাক্তার যেভাবে বলেছেন, ঠিক সেইভাবে ওষুধ সেবন করুন। নিজের ইচ্ছেমতো ডোজ পরিবর্তন করবেন না।
-
বিকল্প চিকিৎসা: যদি সম্ভব হয়, পিপিআই-এর পরিবর্তে অন্য কোনো বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করুন। যেমন – জীবনযাত্রার পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং অন্যান্য ওষুধ।
-
নিয়মিত পরীক্ষা: দীর্ঘকাল ধরে পিপিআই সেবন করলে, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত।
জীবনধারা বা লাইফস্টাইল পরিবর্তন
PPI ওষুধের বিকল্প হিসেবে কিছু জীবনধারা পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক উপায়ে অ্যাসিড রিফ্লাক্স ও গ্যাস্ট্রিক সমস্যার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে:
- খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন: মশলাদার, চর্বিযুক্ত এবং অ্যাসিডিক খাবার পরিহার করে হালকা ও সহজপাচ্য খাবার গ্রহণ করুন।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন অ্যাসিড রিফ্লাক্সের ঝুঁকি বাড়ায়; তাই নিয়মিত ব্যায়াম ও সুষম খাদ্যের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন।
- উপুড় হয়ে শোয়া পরিহার: খাবারের পরপরই শোয়া থেকে বিরত থাকুন এবং রাতে মাথা উঁচু করে শোয়ার চেষ্টা করুন।
- স্ট্রেস ব্যবস্থাপনা: স্ট্রেস হজম প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে; তাই মেডিটেশন, যোগব্যায়াম এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের মাধ্যমে স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করুন।
- ধুমপান বন্ধ করা
উপরোক্ত পরিবর্তনগুলি গ্রহণের মাধ্যমে PPI ওষুধের উপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে হজমজনিত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তবে, কোনো ওষুধ পরিবর্তনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
সূত্রসমূহ
- Freedberg, D. E., Kim, L. S., Song, C., Leonard, M. B., and Abrams, J. A. (2015). The Risk of Clostridium difficile Infection With Proton Pump Inhibitors and H2-Receptor Antagonists: A Meta-Analysis. Gastroenterology, 149(5), 1095–1104.e6.
- Gomm, W., von Holt, K., Thomé, F., Broich, K., Maier, W., Fink, A., … and Haenisch, B. (2016). Association of Proton Pump Inhibitors With Risk of Dementia: A Pharmacoepidemiological Claims Data Analysis. JAMA Neurology, 73(12), 1420–1426.
- Guevara, J.P., Muriithi, J.M., Pillai, P.C., Gerson, L.B. (2022). Proton pump inhibitors and risk of vitamin and mineral deficiency: A comprehensive review. Journal of Clinical Gastroenterology, 56(7), 546-557.
- Khalili, H., Huang, E. S., Ananthakrishnan, A. N., Stevens, T. L., Feskanich, D., and Chan, A. T. (2012). Proton Pump Inhibitors and Risk of Hip Fracture: A Meta-Analysis. The American Journal of Gastroenterology, 107(11), 1753–1761.
- Nochaiwong, S., Ruengorn, C., Awata, P., and Laoveeravat, P. (2016). Proton Pump Inhibitors and Risk of Incident Chronic Kidney Disease: A Systematic Review and Meta-Analysis. PLoS ONE, 11(12), e0168414.
- Shah, N. H., LePendu, P., Bauer-Mehren, A., Ghebremariam, Y. T., Leeper, N. J., and Cooke, J. P. (2015). Proton Pump Inhibitors and Risk of Incident Myocardial Infarction: A Population-Based Study. PLoS ONE, 10(6), e0124653.
আমাদের প্রতিটি লিখা চিকিৎসক দ্বারা লিখিত ও সম্পাদিত। এই ওয়েবসাইটে চিকিৎসক বলতে নুন্যতম এম বি বি এস ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের বোঝানো হয়। এই ওয়েবসাইটের সকল লেখা সচেতনতামূলক এবং চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়।