অ্যানজাইনা (Angina) হলো এক ধরণের বুকের ব্যথা যার উৎপত্তিস্থল হলো আমাদের হৃদপিণ্ড বা হার্ট।
হার্ট সারা দেহে রক্ত ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করে। কিন্তু যখন তার নিজের রক্তনালীগুলো সরু হয়ে যাওয়ায় হার্টের বিভিন্ন অংশে রক্তপ্রবাহ কমে যায় তখন সেসব জায়গা থেকে ব্যাথার উৎপত্তি হয়। বুকে ব্যাথার অনেকগুলো কারনের মধ্যে একটি হলো অ্যানজাইনা।
কিভাবে বুকে এই ব্যথার সৃষ্টি?
সমস্ত হার্ট বা হৃদপিণ্ড জুড়ে কতগুলো রক্তনালি বা ধমনী রয়েছে যেগুলোকে ‘করোনারি আর্টারি‘ বলে। হৃদপিণ্ড নিজেকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তের মাধ্যমে পুষ্টি পৌঁছে দিবার জন্যে এই রক্তনালিগুলো ব্যবহার করে।
যদি এই রক্তনালিগুলোর গায়ে চর্বি জমা হয়ে ক্রমে ক্রমে সংকুচিত হয়ে যায় তাহলে হৃদপিণ্ডে প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে।দেখা দেয় অক্সিজেন ঘাটতি। একে বলা হয় অ্যাথেরোসক্লেরোসিস। এর ফলে হার্টের নিজের রক্তপ্রবাহ কমে যায়। আর এ থেকেই বুকে ব্যথার সুত্রপাত।
কেন জমে রক্তনালিতে চর্বি?
চলুন জেনে নেই কি কি কারণে রক্তনালিতে চর্বি জমার প্রবণতা বেড়ে যায়–
- অপুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ফলে।
- প্রাণিজ চর্বিজাতিয় খাবার অত্যাধিক খেলে।
- ধূমপান।
- বয়স বাড়ার সাথে সাথে।
- বংশগত হৃদরোগজনিত সমস্যা থাকলে।
- অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ।
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস।
কি কি লক্ষন দেখে বুকের অন্যসব ব্যথা থেকে অ্যানজাইনা বা বুকে ব্যথা আলাদা করবেন?
- এ ধরণের ব্যথা সাধারণত বুকে চাপ দেওয়ার মতো অনুভব হয়। মনে হবে যেন কেউ বুক চেপে ধরে রেখেছে কিংবা বুকে বড় পাথর রেখে দিয়েছে।
- বুক ভারী ভারী মনে হবে।
- সাধারণত বেশি পরিশ্রমের ফলে এই ব্যথা শুরু হয়।
- সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময়।
- ব্যথা বুকের পাশাপাশি হাতে, গলায়, পিঠে, পেটের উপরের দিকে বা চোয়ালে ছড়িয়ে পরে কারো কারো ক্ষেত্রে। এ ধরণের ছড়ানোকে বলা হয় রেডিয়েশন অফ পেইন।
- ব্যথা শুরুর পর কাজে না থেকে বিশ্রামে গেলে সল্প সময় ব্যথা থাকে।
- কারো কারো ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
- হাঁটাচলার পাশাপাশি দুশ্চিন্তা করলে, পেট ভরে খেলে এ ধরণের ব্যথা হয়।
অ্যানজাইনার ব্যথার প্রকারভেদঃ
- স্থিতিশীল বুকে ব্যথা(Stable Angina)- এ ধরণের ব্যথা সাধারণত পরিশ্রম করার পর অনুভব হয় এবং বিশ্রামের কিছুক্ষণের মধ্যেই কমে যায়।
- অস্থিতিশীল বুকে ব্যথা(Unstable Angina)- যেকোন সময় অনুভব হতে পারে এবং বিশ্রামের পরেও কমে না। এ ধরণের ব্যথার জন্যে অতিদ্রুত একজন ডাক্তারের নিকট যেতে হবে।
কি করবেন যখন বুকে ব্যথা শুরু হবে?
আপনি যদি জানেন না যে আপনার অ্যানজাইনা আছে কি না, তাহলে–
- ব্যথা অনুভবের সাথে সাথে আপনি যা করছিলেন তা করা বন্ধ করুন এবং বিশ্রাম নিন।
- ব্যথা কমার সাথে সাথে একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।
- যদি ব্যথা ৫–১০ মিনিটের মধ্যে না কমে আসে তবে আপনার হার্ট অ্যাটাক হবার সম্ভাবনা আছে। তাই অতিদ্রুত এম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করুন।
- যদি অ্যাসপিরিন জাতিয় ওষুধ আপনার নিকটে থেকে থাকে তবে অ্যাম্বুল্যান্স আসার আগে একটি অ্যাসপিরিন খেয়ে নিন। এতে করে আপনার হার্ট অ্যাটাকের ঝুকি এবং ব্যথা হ্রাস পাবে।
আপনি যদি ইতোমধ্যেই জানেন যে আপনার অ্যানজাইনা আছে , তাহলে –
- যা করার মধ্যে ছিলেন সেটি বন্ধ করুন এবং বিশ্রাম নিন।
- রেজিস্ট্রার ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক সাথে সবসময় গ্লিসারাইল ট্রাইনাইট্রেট (glyceryl trinitrate or GTN) বা নাইট্রো গ্লিসারিন জাতিয় স্প্রে বা ট্যাবলেট বা দুটিই রাখুন।
- যখনই ব্যথা শুরু হবে তখন বিশ্রামে গিয়ে উপরে লিখিত স্প্রে জিহ্বার নিচে ১–২ বার স্প্রে করুন। একসাথে এর বেশি করা যাবেনা। সাথে নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ খাবেন।
- যদি ৫–৭ মিনিটের মধ্যে উপশম না হয় তবে আবারো একই প্রক্রিয়ায় ১–২ বার স্প্রে করুন।
- যদি তারপরও না কমে তবে অতিদ্রুত অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্তা করে নিকটস্থ হাতপাতালের জরুরি বিভাগে যান।
চিকিৎসক কি করবেন?
আপনার রোগ বর্ননা শুনে এবং শারীরিক পরীক্ষার পর আপনার এনজাইনা হয়েছে মনে হলে আপনাকে বিভিন্ন টেস্ট করতে দিতে পারেন। যেমন
- ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি)- এটির মাধ্যমে আপনার হার্টের ছন্দ এবং কম্পনের অবস্থা নির্ণয় করবেন।
- ইকোকার্ডিওগ্রাম(ইকো)- এটির মাধ্যমে হার্টের বাল্ব পরীক্ষা করে দেখবেন।
- করোনারি এ্যানজিওগ্রাফি– এটির মাধ্যমে আপনার হার্টের রক্তনালিতে চর্বি জমে কোনো ব্লক আছে কিনা দেখবেন।
- রক্ত পরীক্ষা
আপনি যদি একজন অ্যানজাইনা রোগী হিসেবে শনাক্ত হন?
১.চিকিৎসাঃ
ক) ওষুধঃ
–স্থিতিশীল ব্যথার ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক যখন ব্যথা অনুভূতি হয় তখন গ্লিসারাইল ট্রাইনাইট্রেট ট্যাবলেট খাবেন অথবা স্প্রে জিহ্বার নিচে ১–২ বার করবেন।
–অস্থিতিশীল ব্যথার ক্ষেত্রে দৈনিক উপরে বর্ণিত ট্যাবলেটটি ডাক্তারের পরামর্শে খেতে হবে সারাজীবনের জন্যে। আর যখন ব্যথা অনুভব হয় তখন স্প্রেও ব্যবহার করতে হবে।
এছাড়া আরো কিছু ওষুধ নিয়মিত খাওয়ার জন্য আপনার চিকিৎসক বলে দিবেন।
খ)সার্জারীঃ যদি ওষুধের মাধ্যমে ব্যথার উপশম না হয় এবং ব্যথা দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী থাকে তখন একজন কার্ডিয়াক সার্জনের শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি তখন করোনারী অ্যাজিওগ্রাম পরীক্ষাটি করে দেখবেন আপনার হার্টের ধমনী বা রক্তনালিতে কোনো ব্লক আছে কিনা এবং সিটি গুরুতর কিনা।
অতঃপর ২ ধরণের সার্জারী করা হয়ে থাকে–
- করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফটিং (CABG): যাকে সবাই ‘ওপেন হার্ট সার্জারী‘ নামে চিনে। এই অপারেশনের মাধ্যমে সার্জন শরীরের অন্য কোনো জায়গা (সাধারণত পা) থেকে রক্তনালি কেটে এনে ব্লক হয়ে যাওয়া নালির পরিবর্তে অন্য একটি রক্ত চলাচলের রাস্তা করে দেন।
- করোনারি অ্যানজিওপ্লাস্টি এবং স্টেন্ট বসানোঃ এক্ষেত্রে সার্জন বন্ধ হয়ে সরু হয়ে যাওয়া রক্তনালিতে স্টেন্ট (যাকে সবাই রিং বসানো নামে চিনে) স্থায়ীভাবে বসিয়ে আবার আগের অবস্থায় নিয়ে আসেন।
উভয় প্রক্রিয়াই কার্যকর ভূমিকা রাখে। কারণ হার্টে যেই স্থানে পর্যাপ্ত রক্ত চলাচলে বাঁধার জন্যে অক্সিজেন এবং পুষ্টির ঘাটতি ছিলো সেটি সার্জন উপরোক্ত প্রক্রিয়ায় ঠিক করে দেন। ফলে ব্যথার উপশম ঘটে।
কিন্তু অপারেশনের পরেও ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে।
অ্যানজাইনা প্রতিরোধের উপায় কি?
- ধূমপান– এটি ছাড়ার ফলে হৃদপিণ্ডে চাপ কমে যায়।
- উচ্চ রক্তচাপ– উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের সবসময় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
- খাদ্যাভাস– খাবার গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের ফলে রক্তে চর্বি এবং কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। তাছাড়া প্রাণিজ চর্বি, তৈল জাতিয় খাবার অত্যধিক গ্রহনের ফলেও রক্তে চর্বি এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। তাছাড়াও লবণ কম খাওয়া, ননীমুক্ত দুধ খাওয়া এবং বেশি বেশি ফল, সবুজ শাকসবজি ও পানি পান করা।
- মানসিক অস্তিরতা– অত্যধিক টেনশন বা মানসিক চাপ পরিহার করা। সবসময় মনকে প্রফুল্ল রাখতে চেষ্টা করা।
- অতিরিক্ত ওজন– ওজন কমাতে নিয়মিত বয়স অনুযায়ী ব্যায়াম করা বা অন্তত ২০ মিনিট হাঁটা।
অ্যানজাইনা বা বুকে ব্যথার পরিনতি কি হতে পারে?
সময়মতো চিকিৎসা না করালে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে না চললে নিম্নোক্ত সমস্যাগুলি হতে পারে –
- উচ্চ রক্তচাপ
- হার্ট অ্যাটাক
- ব্রেইন স্ট্রোক
এজন্য কোন ধরনের বুকে ব্যথাকেই অবহেলা করবেন না।
আমাদের প্রতিটি লিখা চিকিৎসক দ্বারা লিখিত এবং সম্পাদিত। এই ওয়েবসাইটে চিকিৎসক/ডাক্তার বলতে নুন্যতম এম বি বি এস বা বি ডি এস ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের বোঝানো হয়। এই ওয়েবসাইটের সকল লেখা সচেতনতামূলক এবং চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়।