আলজেইমার ডিজিজ (Alzheimer’s disease) মস্তিষ্কের একটি রোগ, যা ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। আলজেইমার সাধারণত বয়স্ক মানুষের মধ্যে দেখা যায়, তবে এটা বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক কোনো সমস্যা নয়। এটি মস্তিষ্কের একটি রোগ, যেখানে মস্তিষ্কের কোষগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়।
আলজেইমার রোগে মস্তিষ্কে কী ঘটে?
এই রোগে মস্তিষ্কে কিছু অস্বাভাবিক প্রোটিন জমা হতে শুরু করে, যা “প্ল্যাক” (plaques) এবং “ট্যাঙ্গল” (tangles) তৈরি করে। এই প্ল্যাক ও ট্যাঙ্গলের কারণে মস্তিষ্কের কোষগুলোর স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয় এবং কোষগুলো ধীরে ধীরে মারা যায়। প্রথমে মস্তিষ্কের স্মৃতি তৈরি করার অংশে এই ক্ষতি শুরু হয়, কিন্তু পরে এটি পুরো মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে।
আলজেইমার রোগের লক্ষণ:
আলজেইমার রোগের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। প্রথম দিকে লক্ষণগুলো এতটাই সামান্য থাকে যে অনেকে মনে করেন এটা স্বাভাবিক বয়সজনিত কারণে হচ্ছে। কিন্তু রোগ বাড়ার সাথে সাথে লক্ষণগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলে। কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
-
স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া: নতুন তথ্য মনে রাখতে অসুবিধা হওয়া একটি অন্যতম লক্ষণ। যেমন, কোনো তারিখ বা ঘটনা মনে রাখতে না পারা, একই প্রশ্ন বারবার করা এবং মনে রাখার জন্য নোট বা অন্য কোনো ডিভাইসের উপর বেশি নির্ভর করা।
-
পরিকল্পনা ও সমস্যা সমাধানে অসুবিধা: কোনো রেসিপি অনুসরণ করতে, হিসাব-নিকাশ করতে বা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হওয়া।
-
সময় ও স্থান নিয়ে বিভ্রান্তি: পরিচিত জায়গায় পথ হারিয়ে ফেলা, তারিখ বা সময় মনে রাখতে না পারা।
-
দৃষ্টি ও স্থানিক সম্পর্ক বুঝতে অসুবিধা: দূরত্ব বুঝতে, পড়তে বা ম্যাপ বুঝতে সমস্যা হওয়া।
-
কথা বলতে সমস্যা: কথা খুঁজে পেতে অসুবিধা হওয়া, স্বাভাবিক কথোপকথন বুঝতে সমস্যা হওয়া।
-
জিনিসপত্র ভুল স্থানে: জিনিসপত্র ভুল জায়গায় রাখা এবং পরে তা খুঁজে বের করতে না পারা।
-
সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা: ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া, যেমন কাউকে অনেক টাকা দিয়ে দেওয়া।
-
সামাজিক কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া: শখের কাজ, সামাজিক অনুষ্ঠানে বা কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
-
মেজাজ ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন: বিভ্রান্ত, সন্দেহপ্রবণ, হতাশ, উদ্বিগ্ন বা খিটখিটে হয়ে যাওয়া।
কারণ ও ঝুঁকির কারণ:
আলঝেইমার রোগের সঠিক কারণ এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে জিনগত, জীবনযাপন এবং পরিবেশগত কিছু কারণ এর জন্য দায়ী।
-
বয়স: বয়স বাড়ার সাথে সাথে আলঝেইমারের ঝুঁকি বাড়ে। ৬৫ বছর বয়সের পর প্রতি পাঁচ বছরে এই ঝুঁকি দ্বিগুণ হতে থাকে।
-
পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারের কারো আলঝেইমার থাকলে আপনারও এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
-
জিন (Gene): কিছু জিন আলজেইমার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
-
জীবনযাপন: গবেষণা থেকে জানা যায় যে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম এবং সামাজিক কাজকর্মের মাধ্যমে আলজেইমার ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় এমন কিছু বিষয়, যেমন উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল এবং ডায়াবেটিস, আলঝেইমারের ঝুঁকিও বাড়াতে পারে।
-
মাথায় আঘাত: মাথায় গুরুতর আঘাত পেলে ভবিষ্যতে আলঝেইমার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
রোগ নির্ণয়:
আলঝেইমার রোগ নির্ণয় করা কঠিন হতে পারে, কারণ এর জন্য কোনো একটি নির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। ডাক্তাররা সাধারণত নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করেন:
-
শারীরিক পরীক্ষা ও রোগীর ইতিহাস: রোগীর লক্ষণ, রোগের ইতিহাস এবং পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা।
-
স্নায়বিক পরীক্ষা: রিফ্লেক্স, মাংসপেশীর শক্তি, হাঁটাচলার ক্ষমতা এবং অন্যান্য স্নায়বিক কার্যক্রম পরীক্ষা করা।
-
মানসিক অবস্থা পরীক্ষা: স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনার ক্ষমতা, ভাষার ব্যবহার এবং অন্যান্য মানসিক কার্যক্রম মূল্যায়ন করা।
-
ব্রেইন ইমেজিং: এমআরআই (MRI) এবং সিটি স্ক্যান (CT scan) করে মস্তিষ্কে স্ট্রোক বা টিউমারের মতো অন্য কোনো সমস্যা আছে কিনা, তা দেখা হয়। এছাড়া পিইটি স্ক্যান (PET scan) করে মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক প্রোটিনের উপস্থিতি নির্নয় করা।
-
রক্ত পরীক্ষা: থাইরয়েড সমস্যা বা ভিটামিনের অভাবের কারণে স্মৃতি কমে গেলে, তা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা:
আলঝেইমার রোগের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, যা এই রোগ সম্পূর্ণ ভালো করতে পারে। তবে কিছু চিকিৎসা আছে, যা রোগের লক্ষণগুলো কমাতে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে।
-
জীবনযাত্রার পরিবর্তন:
নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাবার এবং সামাজিক কাজকর্মের মাধ্যমে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা যায়।
একটি নিরাপদ এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে রোগীর আচরণগত লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
-
থেরাপি:
কগনিটিভ ট্রেনিং (cognitive training) স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
অকুপেশনাল থেরাপি (occupational therapy) রোগীদের দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে এবং স্বাধীনভাবে বাঁচতে সাহায্য করে।
স্পিচ থেরাপি (speech therapy) যোগাযোগে সমস্যা হলে সাহায্য করে।
-
ওষুধ:
বিভিন্ন ধরনের ঔষুধ আছে যা রোগের কারনে হওয়া অসুবিধাগুলো কিছুটা কমাতে পারে। সাধারনত এই ঔষুধগুলো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিতে পারেন।
পরিবারের সদস্যদের জন্য সহায়তা:
আলজেইমার রোগীর যত্ন নেয়া খুবই কঠিন হতে পারে, মানসিকভাবে এবং শারীরিকভাবে। তাই যারা রোগীর যত্ন নেন, তাদের নিজেদেরও যত্ন নেয়া উচিত এবং প্রয়োজনে সাহায্য চাওয়া উচিত। কিছু সহায়তার উৎস:
-
সাপোর্ট গ্রুপ: একই ধরনের পরিস্থিতিতে থাকা অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করলে মানসিক সমর্থন এবং ব্যবহারিক পরামর্শ পাওয়া যায়।
-
শিক্ষামূলক উপকরণ: আলজেইমার রোগ এবং এর পরিচর্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানলে, যত্ন নেয়া সহজ হয়।
-
পেশাদার পরামর্শ: একজন থেরাপিস্ট বা কাউন্সেলরের সাথে কথা বললে মানসিক চাপ মোকাবেলা করা যায়।
আলঝেইমার নিয়ে জীবনযাপন:
আলঝেইমার রোগ অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে, তবে এটা মনে রাখা জরুরি যে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও অর্থপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারেন। সঠিক যত্ন, সহায়তা এবং সহানুভূতি দিয়ে পরিবার এবং সমাজ তাদের মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে।
আমাদের প্রতিটি লিখা চিকিৎসক দ্বারা লিখিত ও সম্পাদিত। এই ওয়েবসাইটে চিকিৎসক বলতে নুন্যতম এম বি বি এস বা বি ডি এস ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের বোঝানো হয়। এই ওয়েবসাইটের সকল লেখা সচেতনতামূলক এবং চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়।