গনোরিয়া হচ্ছে একটি যৌন সংক্রমিত রোগ (STI) যা Neisseria gonorrhoeae নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা হয়ে থাকে ।
এটি যেকোনো ধরনের যৌন সংযোগ স্থাপন করার মাধ্যমে ছড়ায় যা পুরুষ-মহিলা উভয়কেই সংক্রমিত করতে পারে।
গর্ভবতী মহিলার কাছ থেকে তার শিশুর কাছেও এই সংক্রমণ ছড়াতে পারে। আপনি যদি গর্ভবতী হন এবং গনোরিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে আপনার শিশুর জন্মের আগে পরীক্ষা করা এবং চিকিৎসা করা জরুরি।
গনোরিয়া চুমু, আলিঙ্গন, সুইমিং পুল, টয়লেট সিট বা একই গোসলখানা, তোয়ালে, কাপ, প্লেট বা থালা ব্যাবহারের মাধ্যমে ছড়ায় না।কারন এ ব্যাকটেরিয়া মানুষের দেহের বাইরে বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না।
প্রাথমিকভাবে ডাক্তার এর শরণাপন্ন হলে এর কার্যকর চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু যদি কেউ চিকিৎসা না করান, তাহলে গনোরিয়া দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
কারণঃ
গনোরিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াগুলি সাধারণত শরীরের উষ্ণ, আর্দ্র অঞ্চলগুলিতে বিকাশ লাভ করে এবং সংক্রমণ শরীরের যেকোনো শ্লেষ্মা ঝিল্লিতে(মিউকাস মেম্ব্রেন)বিস্তৃত হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে যৌনাঙ্গ, মুখ, গলা, চোখ এবং মলদ্বার।
কনডম বা অন্য কোনো প্রতিরোধক পদ্ধতি ছাড়া মৌখিক, পায়ূ, বা যোনি সহবাসের মাধ্যমে গনোরিয়া সংক্রমিত হয়।
লক্ষণ
পুরুষের ক্ষেত্রে–
- অনেকক্ষেত্রে কখনও লক্ষণীয় কোনও উপসর্গ থাকে না।
- সাধারণত, সংক্রমণ হওয়ার এক সপ্তাহ পরে উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে।
- প্রথম এবং প্রধান উপসর্গ হল প্রস্রাবের সময় জ্বলুনি বা বেদনাদায়ক অনুভুতি।
এটি অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে অন্যান্য উপসর্গগুলি দেখা দিতে পারে,যেমন:
- পেনিস বা পুরুষাঙ্গ থেকে পুজের মত স্রাব বের হওয়া
- পেনিস ফুলে যাওয়া বা লাল হওয়া
- অণ্ডকোষে(testicules) ফোলা বা ব্যথা
- অনেকদিন থেকে গলা ব্যথা
বিরল ক্ষেত্রে, গনোরিয়া শরীরের ক্ষতির কারণ হতে পারে, বিশেষ করে মূত্রনালী এবং অণ্ডকোষে।।ব্যথা মলদ্বারে পর্যন্তও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
মহিলাদের ক্ষেত্রেঃ
গনোরিয়া আক্রান্ত বেশিরভাগ মহিলারই কোন উপসর্গ থাকেনা।
এমনকি যখন উপসর্গ দেখা দেয়,তা এতোটাই অল্পমাত্রায় থাকে যে অনেকসময় তা মূত্রাশয় বা যোনি সংক্রমণ মনে করে ভুল হতে পারে। গনোরিয়া আক্রান্ত মহিলারা সংক্রমণ থেকে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টির ঝুঁকিতে থাকে।
লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- যোনি স্রাব বৃদ্ধি
- পিরিয়ডের মতো রক্তপাত
- প্রস্রাবের সময় জলন্ত ও বেদনাদায়ক অনুভুতি এবং ঘন ঘন প্রস্রাব করার তাগিদ
- যৌন মিলনের সময় ব্যথা
- তলপেটে তীব্র ব্যথা
- জ্বর
মলদ্বারে গনোরিয়া হলে– উপসর্গের মধ্যে রয়েছে মলদ্বার চুলকানি, মলদ্বার থেকে পুঁজের মতো স্রাব,টয়লেট টিস্যুতে উজ্জ্বল লাল রক্তের দাগ এবং মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা।
চোখে হলে– চোখের ব্যথা, আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা এবং এক বা উভয় চোখ থেকে পুঁজের মতো স্রাব বের হতে পারে।
গলায় হলে– গলা সংক্রমণের লক্ষণগুলির মধ্যে গলা ব্যথা এবং গলায় ফুলে যাওয়া লিম্ফ নোড অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
জয়েন্টে হলে – যদি এক বা একাধিক জয়েন্ট ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয় (সেপটিক আর্থ্রাইটিস), আক্রান্ত জয়েন্টগুলো উষ্ণ, লাল, ফোলা এবং অত্যন্ত বেদনাদায়ক হতে পারে, বিশেষ করে চলাফেরার সময়।
যাদের পরীক্ষা করা উচিত,
- আপনি বা আপনার সঙ্গী যদি মনে করেন আপনাদের গনোরিয়ার লক্ষণ আছে
- আপনি একজন নতুন সঙ্গীর সাথে অরক্ষিতভাবে যৌন মিলন করেছেন
- আপনি বা আপনার সঙ্গীর একের অধিক যৌনসঙ্গী থাকলে
- আপনি বা আপনার সঙ্গীর অন্য কোনো STI বা যৌনরোগ থাকলে।
জটিলতাঃ
চিকিৎসা না করা গনোরিয়া বড় জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন:
মহিলাদের মধ্যে বন্ধ্যাত্ব- গনোরিয়া জরায়ু এবং ফ্যালোপিয়ান টিউবে ছড়িয়ে যেতে পারে, যার ফলে শ্রোণী প্রদাহজনিত রোগ (পিআইডি) হয়। পিআইডি টিউবের ঘা করতে পারে,গর্ভাবস্থার জটিলতা এবং বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বাড়ায়। PID এর অবিলম্বে চিকিৎসা প্রয়োজন।
পুরুষদের মধ্যে বন্ধ্যাত্ব- গনোরিয়ার কারনে অণ্ডকোষের পিছনের অংশে একটি ছোট, কুণ্ডলীযুক্ত নল (এপিডিডাইমিস)অবস্থিত যাতে ইনফেকশন (এপিডিডাইমাইটিস) হতে পারে। চিকিৎসা না করা এপিডিডাইমাইটিস বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে।
সংক্রমণ যা জয়েন্ট এবং শরীরের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে-ব্যাকটেরিয়া,যা গনোরিয়া সৃষ্টি করে তা রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং জয়েন্টগুলিসহ শরীরের অন্যান্য অংশকে সংক্রামিত করতে পারে।
এইচআইভি/এইডসের ঝুঁকি বাড়ায়-গনোরিয়া হলে হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি)যা এইডস এর জন্য দায়ী,তার সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেশি বেড়ে যায়।
শিশুদের মধ্যে জটিলতা- যেসব শিশু জন্মের সময় মায়ের কাছ থেকে গনোরিয়ায় আক্রান্ত হয় তাদের অন্ধত্ব, মাথার ত্বকে ঘা এবং সংক্রমণ হতে পারে।
গর্ভাবস্থা এবং প্রসবের সময় সংক্রমণের আরও জটিলতা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসা ছাড়া, এটি অকাল প্রসব বা মৃতসন্তান প্রসব হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
মহিলাদের পরীক্ষাঃ
একজন ডাক্তার বা নার্স সাধারণত অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার সময় যোনি বা জরায়ুর (গর্ভের প্রবেশদ্বার) থেকে সোয়াব এর মাধমে নমুনা সংগ্রহ করবেন।কিছু ক্ষেত্রে, মূত্রনালী (শরীর থেকে প্রস্রাব বহনকারী নল)থেকেও একটি নমুনা নিয়ে থাকেন।
মহিলাদের সাধারণত গনোরিয়া পরীক্ষা করার জন্য প্রস্রাবের নমুনা দিতে বলা হয় না কারণ এ পরীক্ষার মাধ্যমে মহিলাদের সঠিক রোগ নির্ণয় সম্ভব হয় না।
পুরুষদের পরীক্ষা করাঃ
পুরুষদের সাধারণত প্রস্রাবের নমুনা দিতে বলা হয় অথবা পেনিস থেকে সোয়াবের মাধ্যমে স্রাবের নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
যদি আপনাকে প্রস্রাবের নমুনা দিতে বলা হয়, তাহলে প্রায় ২ ঘন্টা আগে প্রস্রাব না করা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে করে ব্যাকটেরিয়া ধুয়ে যেতে পারে এবং পরীক্ষার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।
মলদ্বার, গলা এবং চোখের সংক্রমণঃ
যদি আপনার মলদ্বার বা গলা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে এসব জায়গা থেকেও সোয়াব এর মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করবে।
আপনার চোখে সংক্রমনের লক্ষন থাকলে চোখ থেকে নিঃসৃত স্রাবের নমুনা আপনার চোখ থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।
গনোরিয়া কি নিরাময় করা যায়?
হ্যাঁ, সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে গনোরিয়া নিরাময় করা যায়।সংক্রমণ নিরাময়ের জন্য ডাক্তার দ্বারা প্রদত্ত সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
গনোরিয়ার চিকিৎসার জন্য সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়।নির্দেশাবলী অনুযায়ী ঔষধ গ্রহণ করতে ভুলবেন না,এমনকি উপসর্গগুলি ভালো হয়ে আপনি ভাল বোধ করতে শুরু করলেও।
নিজে থেকে বা ফার্মেসীওয়ালাদের পরামর্শে কোভভাবেই কোন এন্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না।
গনোরিয়া হলে আমার আর কি করা উচিত?
নিরাপদ থাকতে এবং আপনার যৌনসঙ্গীকে নিরাপদ রাখতে আপনার উচিত:
- গত তিন মাসে আপনি যার সাথে সেক্স করেছেন তাকে বলুন যে আপনার গনোরিয়া আছে। এটি করা গুরুত্বপূর্ণ কারণ গনোরিয়া কোন উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে না।বিশেষত মহিলাদের সচরাচর লক্ষণ দেখা না দেয়ার কারণে তারা পরীক্ষা করে চিকিৎসা নেয় না।
- পুনরায় যৌন জীবন শুরু করার আগে ঔষধ শেষ করার পর কমপক্ষে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করুন।
- সেক্স করার সময় কনডম ব্যবহার করুন।
- এইচআইভি (এইডস) এবং অন্যান্য এসটিডি (সিফিলিস, হারপিস, ক্ল্যামিডিয়া) এর জন্য পরীক্ষা করুন।
প্রতিরোধঃ
আপনার গনোরিয়ার ঝুঁকি কমাতে:
- কনডম ব্যবহার করুন।
- আপনার যৌন সঙ্গীর সংখ্যা সীমিত করুন। শুধুমাত্র একজন যৌনসঙ্গী আপনার ঝুঁকি কমাতে পারে।
- নিশ্চিত হোন যে আপনি এবং আপনার সঙ্গী যৌন সংক্রমণের জন্য পরীক্ষিত।
- যৌন সংক্রমণ আছে বলে মনে হয় এমন কারো সাথে সেক্স করা থেকে বিরত থাকুন।যদি আপনার সঙ্গীর যৌন সংক্রমণের লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে, যেমন প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া বা যৌনাঙ্গে ফুসকুড়ি বা ঘা তাহলে তাকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ নিন।
- সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিন।
গনোরিয়া ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট অন্য যেকোনো রোগের মতই একটি রোগ এবং অন্যান্য রোগের মতই এ রোগের রোগীরাও সুচিকিৎসার দাবীদার। এই রোগের লক্ষন দেখা দেয়ার সাথে সাথে আপনার নিকটস্থ চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিন। এটি একটি ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ, সুতরাং কোন ধরনের হোমিওপ্যাথী, ভেষজ, বা কবিরাজি চিকিৎসা করে নিজের ক্ষতি করবেন না।
লিখেছেন,
মালিহা জান্নাত, এম বি বি এস স্টুডেন্ট
রিভিউ করেছেন,
লিখেছেন,
লিখেছেন,
ডা কামরুল ইসলাম শিপু
এম বি বি এস,
এম এস সি (ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজ)
দ্য ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা
ক্লিনিক্যাল রিসার্চ ফেলো ইন ভ্যাকসিনোলজি
দ্য ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড