জ্বর হলো শরীরের তাপমাত্রার সাময়িক বৃদ্ধি। এটি সাধারনত শরীরের রোগ প্রতিরোধের একটি পদ্ধতি হিসেবে আমাদের প্রতিরক্ষা সিস্টেম বা ইমিউন সিস্টেমের মাধ্যমে হয়ে থাকে । জ্বর সাধারণত সংক্রমণের কারণে হয়।
বেশিরভাগ শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য জ্বর কষ্টকর একটি অভিজ্ঞতা । এটি সাধারণত ভয়ের কোন কারণ নয়। কিন্তু শিশুদের জন্য কম জ্বরও গুরুতর সংক্রমণ এর লক্ষন হতে পারে।
জ্বর সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যে চলে যায়। ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধই যেমন প্যারাসিটামল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যথেষ্ট ।
জ্বর কেন হয়?
শরীরের সাধারণ তাপমাত্রা শরীরের তাপ উত্পাদন এবং তাপ নিঃসরনের একটি ভারসাম্য। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস নামক একটি জায়গা, যা শরীরের “থার্মোস্ট্যাট” নামেও পরিচিত – এই ভারসাম্য নিয়ন্ত্রন করে। যখন সুস্থ থাকেন, আপনার শরীরের তাপমাত্রা সারাদিনে সামান্য পরিবর্তিত হয়। এটি সকালে কম এবং শেষ বিকেল এবং সন্ধ্যায় সামান্য বেশি হতে পারে।
যখন আপনার ইমিউন সিস্টেম কোন রোগের বিরুদ্ধে ফাইট করে, তখন হাইপোথ্যালামাস আপনার শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয় বাহির থেকে আসা জীবানুগুলোর বিস্তার কমিয়ে রাখতে।
জ্বর এর সময় আপনি যে কাঁপুনি অনুভব করতে পারেন তা হল শরীর তাপ উৎপন্ন করার একটি উপায়।কাপুনির কারনে শরীরের ভিতরের তাপমাত্রা বাড়ে কিন্তু আপনার তখন মনে হয় আপনার ঠাণ্ডা লাগছে এবং শরীর গরম করার জন্য কাথা বা কম্বলে মুড়িয়ে থাকেন, আসলে তখন আপনি আপনার শরীরকে তাপ ধরে রাখতে সাহায্য করছেন।
জ্বর বা শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ:
- ভাইরাল সংক্রমণ
- ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ
- উচ্চ তাপমাত্রায় যেমন অতিরিক্ত রোদে বেশিক্ষন থাকা
- কিছু প্রদাহ, যেমন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস
- বিভিন্ন ক্যান্সার
- কিছু ওষুধ, যেমন অ্যান্টিবায়োটিক এবং ওষুধ উচ্চ রক্তচাপ বা খিঁচুনি চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ঔষুধ
- ভ্যাকসিন নেয়ার পর, যেমন বাচ্চাদের ইপিআই এর ভ্যাকসিন বা বড়দের কোভিড১৯ ভ্যাকসিন
অন্যান্য লক্ষন:
শরীরের তাপমাত্রা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি এবং দিনের বিভিন্ন সময়ে সামান্য পরিবর্তিত হয়। শরীরের নরমাল তাপমাত্রা ৯৮.৬ ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ধরা হয়। মুখের থার্মোমিটার ব্যবহার করে ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রাকে সাধারণত জ্বর বলে মনে করা হয়।
জ্বরের কারণের উপর নির্ভর করে অন্যান্য লক্ষণ এবং উপসর্গ দেখা যেতে পারে যেমন:
- ঘাম
- ঠান্ডা এবং কাঁপুনি
- মাথাব্যথা
- পেশী ব্যাথা
- ক্ষুধামন্ধা
- বিরক্তি
- পানিশূন্যতা
- দূর্বলতা
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
শিশুদের ক্ষেত্রে-
শিশু এবং ছোটদের জ্বর সবসময় চিন্তার একটি কারণ। চিকিতসকের কাছে যেতে হবে যদি-
- ৩ মাসেরও কম বয়সী এবং মলদ্বারের তাপমাত্রা ১০০.৪ ফারেনহাইট বা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয়।
- ৩ থেকে ৬ মাস বয়সের মধ্যে এবং মলদ্বারের তাপমাত্রা ১০২ ফারেনহাইট বা ৩৮.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রা থাকে এবং এরচেয়ে কম তাপমাত্রায়ও যদি শিশু অস্বাভাবিকভাবে কান্নাকাটি করে, দুর্বল হয়ে যায় এবং দেখে মনে হয় খুব কষ্ট পাচ্ছে।
- ৭ থেকে ২৪ মাস বয়সের মধ্যে এবং মলদ্বারের তাপমাত্রা ১০২ ফারেনহাইট বা ৩৮.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর চেয়ে বেশি যা এক দিনের বেশি স্থায়ী হয় ।
যদি আপনার সন্তানের অন্যান্য লক্ষণ ও উপসর্গ থাকে, যেমন নাক দিয়ে পানি পড়া, কাশি বা ডায়রিয়া, তাহলে জ্বর যতো কমই থাকুক সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে যান বা হাসপাতালে নিয়ে যান।
সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে যদি বাচ্চার নিম্নোক্ত কোন উপসর্গ থাকেঃ
- বাবা মায়ের চোখের সাথে চোখ রেখে তাকাচ্ছে না
- অতিরিক্ত কান্নাকাটি, বারবার বমি, প্রচণ্ড মাথাব্যথা, গলা ব্যথা, পেটব্যথা মনে হচ্ছে।
- তিন দিনের বেশি জ্বর।
- জ্বরের সাথে খিঁচুনি আছে ।
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে-
আপনার শরীরের তাপমাত্রা ১০৩ ফারেনহাইট বা ৩৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর চেয়ে বেশি হলে ডাক্তারের কাছে যান ।
জ্বরের সাথে যদি এই লক্ষণ বা উপসর্গগুলির মধ্যে কোনটি থাকে তবে অবিলম্বে হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে যেতে হবে-
- প্রচন্ড মাথাব্যথা
- গায়ে কোন ফুসকুড়ি
- উজ্জ্বল আলোতে অস্বাভাবিক সংবেদনশীলতা
- আপনার মাথা সামনের দিকে বাঁকানোর সময় ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া এবং ব্যথা লাগা
- মানসিক বিভ্রান্তি,
- ক্রমাগত বমি হওয়া
- শ্বাসকষ্ট বা বুকে ব্যথা
- পেটে ব্যথা
- প্রস্রাব করার সময় ব্যথা
- খিঁচুনি
প্রতিরোধঃ
জ্বর সরাসরি প্রতিরোধ করা যায় না।
যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জ্বর কোন ইনফেকশনের কারনে হয়ে থাকে সেজন্য ইনফেকশন এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করা, ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছনতা মেনে চলা এবং শিশুদের বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে টিকা দিয়ে করা সম্ভব।
কিন্তু সকল প্রতিরোধমুলক ব্যবস্থা নেয়া হলেও ইনফেকশন হতে পারে এবং জ্বর হতে পারে। এজন্য জ্বর হলে প্রয়োজন মতো চিকিৎসা নিতে হবে।
জ্বর কমানোর জন্য কোনভাবেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে থেকে কোন এন্টিবায়োটিক খাবেন না। এটা বড় ক্ষতির কারন হতে পারে।
লিখেছেন,
ডা কামরুল ইসলাম শিপু
এম বি বি এস,
এম এস সি (ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজ)
দ্য ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা
ক্লিনিক্যাল রিসার্চ ফেলো ইন ভ্যাকসিনোলজি
দ্য ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড
আমাদের প্রতিটি লিখা চিকিৎসক দ্বারা লিখিত ও সম্পাদিত। এই ওয়েবসাইটে চিকিৎসক বলতে নুন্যতম এম বি বি এস ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের বোঝানো হয়। এই ওয়েবসাইটের সকল লেখা সচেতনতামূলক এবং চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়।