From a Doctor

টিকা: জীবন রক্ষাকারী এক অপরিহার্য হাতিয়ার

টিকা: জীবন রক্ষাকারী এক অপরিহার্য হাতিয়ার

টিকার ধারণা আজ থেকে হাজার বছর আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। প্রাচীনকালে, মানুষ লক্ষ্য করেছিল যে যারা একবার গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছে, তারা সাধারণত দ্বিতীয়বার এই রোগে আক্রান্ত হয় না। এই পর্যবেক্ষণ থেকেই রোগ প্রতিরোধের ধারণাটির জন্ম।

গুটিবসন্ত প্রতিরোধের জন্য ইনোকুলেশন বা ভ্যারিওলেশন-এর চর্চা প্রাচীন চীনে প্রচলিত ছিল। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর দিকে, চীনারা গুটিবসন্তের ক্ষত থেকে নেওয়া তরল বা শুকনো গুটি ব্যবহার করে সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করিয়ে রোগ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করত। এই পদ্ধতিতে রোগটি হালকাভাবে হতো, কিন্তু এর ফলে শরীরে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতো।

লেডি মেরি ওয়র্টলি মন্ট্যাগিউ ছিলেন একজন ব্রিটিশ লেখিকা এবং অভিজাত নারী। তিনি ১৭১৬ সালে অটোমান সাম্রাজ্যে থাকাকালীন ইনোকুলেশনের পদ্ধতি দেখেন এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি নিজের সন্তানদের শরীরে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন এবং পরে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে এই ধারণাটি প্রচার করেন। তাঁর অবদানের ফলেই ইংল্যান্ডে ইনোকুলেশন জনপ্রিয়তা লাভ করে, যা পরবর্তীতে এডওয়ার্ড জেনারের টিকার গবেষণার পথ খুলে দেয়।

আধুনিক টিকার জনক হিসেবে ধরা হয় এডওয়ার্ড জেনারকে। তিনি ১৭৯৬ সালে গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার করেন। জেনার লক্ষ্য করেন যে গোয়ালিনীরা, যারা কাউপক্স নামক এক ধরনের হালকা রোগে আক্রান্ত হন, তারা গুটিবসন্তের হাত থেকে রক্ষা পান। তিনি কাউপক্সের জীবাণু ব্যবহার করে মানুষের শরীরে গুটিবসন্তের প্রতিরোধ তৈরি করতে সক্ষম হন। এটি ছিল প্রথম সফল টিকা, যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে।

লুই পাস্তুর ১৮৮৫ সালে জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার করেন। তিনি দুর্বল জীবাণু ব্যবহার করে টিকা তৈরির ধারণাটিকে আরও উন্নত করেন। তার কাজ অন্যান্য রোগের টিকা তৈরির পথ খুলে দেয়।

বিংশ শতাব্দীতে টিকা বিজ্ঞানে অনেক উন্নতি সাধিত হয়। এই সময়ে পোলিও, হাম, রুবেলা, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, টিটেনাস এবং হুপিং কাশির মতো রোগের টিকা তৈরি করা হয়। এর ফলে বিশ্বব্যাপী শিশু মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।

বর্তমানে, বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন নতুন রোগ এবং পুরনো রোগের নতুন ধরনের বিরুদ্ধে টিকা তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ক্যান্সার এবং এইডস-এর মতো রোগের টিকা তৈরির চেষ্টাও চলছে। আধুনিক টিকা প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে, এবং বিজ্ঞানীরা এখন আরও নিরাপদ ও কার্যকর টিকা তৈরি করতে পারছেন।

টিকা কীভাবে কাজ করে?

টিকা আমাদের শরীরকে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তৈরি করে। এটা অনেকটা শরীরকে আগে থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো। যখন কোনো রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু, যেমন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে ঢোকে, তখন টিকা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে তোলে। টিকাগুলোতে সেই জীবাণুর দুর্বল বা মৃত অংশ ব্যবহার করা হয়। এগুলো শরীরে ঢুকলে আমাদের শরীর সেগুলোকে চিনে রাখে এবং তাদের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। অ্যান্টিবডি হলো আমাদের শরীরের সৈনিকের মতো, যারা রোগের জীবাণুকে ধ্বংস করে। ভবিষ্যতে যদি সেই একই জীবাণু আবার শরীরে ঢোকার চেষ্টা করে, তাহলে এই অ্যান্টিবডিগুলো দ্রুত তাদের চিনে ফেলে এবং তাদের ধ্বংস করে ফেলে যার ফলে আমরা মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা পাই।

টিকার প্রকারভেদ 

টিকা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। এর প্রধান প্রকারগুলো হলো:

  • লাইভ-এটেনুয়েটেড (Live-Attenuated): দুর্বল জীবিত জীবাণু ব্যবহার করা হয়। যেমন: MMR, চিকেনপক্স। দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা দেয়, তবে দুর্বল ইমিউনিটি সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য উপযুক্ত নয়।
  • ইনঅ্যাকটিভেটেড (Inactivated): মৃত জীবাণু ব্যবহার করা হয়। যেমন: ফ্লু, পোলিও। নিরাপদ, তবে একাধিক ডোজ লাগে।
  • সাবইউনিট (Subunit): জীবাণুর অংশ (যেমন প্রোটিন) ব্যবহার করা হয়। যেমন: হেপাটাইটিস বি, এইচপিভি। নিরাপদ, তবে বুস্টার লাগতে পারে।
  • টক্সয়েড (Toxoid): ব্যাকটেরিয়ার বিষ (টক্সিন) ব্যবহার করা হয়। যেমন: টিটেনাস, ডিপথেরিয়া। সুরক্ষার জন্য বুস্টার প্রয়োজন।
  • এমআরএনএ (mRNA): জেনেটিক কোড ব্যবহার করে শরীরে প্রোটিন তৈরি করা হয়। যেমন: কোভিড-১৯ টিকা। দ্রুত তৈরি করা যায় এবং কার্যকর।

টিকার গুরুত্ব

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)  এর মতে, টিকা বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রমাণিত যে, টিকা বিভিন্ন সংক্রামক রোগ যেমন পোলিও, হাম, রুবেলা, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া ইত্যাদি কমাতে বা নির্মূল করতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

    •  টিকা প্রতি বছর ৩.৫ থেকে ৫ মিলিয়ন মানুষের জীবন বাঁচায়।
    • টিকা ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, হুপিংকফ এবং হামের মতো রোগের প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে।
    • ১৯৮০ সাল থেকে টিকাদানের ফলে পোলিও প্রায় ৯৯% হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশেও টিকা কার্যক্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য উদ্যোগ। সরকার বিভিন্ন সংস্থা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সহায়তায় শিশুদের বিভিন্ন মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা করার জন্য নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে।সরকারের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির ফলে শিশু মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে এবং গড় আয়ু বেড়েছে। হাম-রুবেলা টিকার মাধ্যমে এই রোগের সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে।

কেন শিশুদের টিকা দেওয়া উচিত?

শিশুদের টিকা দেওয়া অনেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে কিছু প্রধান কারণ নিচে দেওয়া হলো:

  • মারাত্মক রোগ থেকে সুরক্ষা: টিকা শিশুদের বিভিন্ন মারাত্মক রোগ যেমন পোলিও, হাম, রুবেলা, হুপিং কাশি, টিটেনাস, ডিপথেরিয়া, মেনিনজাইটিস এবং নিউমোনিয়ার মতো রোগ থেকে রক্ষা করে। এসব রোগ শিশুদের জন্য খুবই ক্ষতিকর এবং এমনকি জীবনঘাতীও হতে পারে।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: টিকা শিশুদের শরীরে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সাহায্য করে। এর ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং তারা সুস্থ থাকে।
  • শিশুদের জীবন বাঁচানো: টিকা দেওয়ার মাধ্যমে প্রতি বছর অনেক শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়। আগে অনেক শিশু যে রোগগুলোর কারণে মারা যেত, টিকা আবিষ্কারের ফলে সেই সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
  • রোগের বিস্তার রোধ: যখন একটি শিশু টিকা নেয়, তখন সে শুধু নিজেকে রক্ষা করে না, বরং অন্যদেরও রক্ষা করে। কারণ টিকা নেওয়া থাকলে সেই শিশু রোগ ছড়ায় না, ফলে সমাজের অন্য শিশুরাও সুরক্ষিত থাকে।
  • দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সুরক্ষা: শৈশবে টিকা নিলে শিশুরা ভবিষ্যতে অনেক রোগ থেকে সুরক্ষিত থাকে। এর ফলে তাদের সুস্থ জীবন যাপনের সম্ভাবনা বাড়ে।
  • চিকিৎসা খরচ কমানো: টিকা দিলে শিশুরা কম অসুস্থ হয়, ফলে তাদের চিকিৎসার খরচ কমে যায়। এছাড়াও, মারাত্মক রোগের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনও কমে যায়।
  • স্কুলে যাওয়ার সুযোগ: সুস্থ থাকলে শিশুরা নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে এবং ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারে।

টিকার বৈশ্বিক ও বাংলাদেশে প্রভাব

  • রোগ প্রতিরোধ: টিকার প্রধান কাজ হলো শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা। এর ফলে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
  • শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস: টিকা দেওয়ার মাধ্যমে শিশুদের মারাত্মক রোগ থেকে বাঁচানো যায়, যা শিশু মৃত্যুহার কমাতে সহায়ক। এছাড়াও, টিটেনাস টিকার মাধ্যমে মা ও নবজাতকের টিটেনাস রোগ প্রতিরোধ করা যায়, যা মাতৃ ও নবজাতকের মৃত্যুহার কমায়।
  • জীবনযাত্রার উন্নতি: সুস্থ জীবন যাপন করার সুযোগ তৈরি হয়, যা জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সাহায্য করে।
  • অর্থনৈতিক সুবিধা: মানুষ সুস্থ থাকলে কর্মক্ষম থাকে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। রোগের চিকিৎসা করাতে যে খরচ হয়, তা-ও কমে যায়।
  • রোগ নির্মূল ও নিয়ন্ত্রণ: টিকার মাধ্যমে অনেক মারাত্মক রোগ নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে এবং অনেক রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা গেছে।

বাংলাদেশে প্রচলিত রুটিন টিকা

বাংলাদেশে শিশুদের জন্য কিছু রুটিন টিকা দেওয়া হয়, যা একটি নির্দিষ্ট সময়সূচী অনুযায়ী দেওয়া হয়ে থাকে। এগুলো হলো:

  • বিসিজি (BCG): যক্ষ্মা রোগের টিকা।
  • পোলিও টিকা (OPV ও IPV): পোলিও রোগ প্রতিরোধের জন্য।
  • পেন্টাভ্যালেন্ট টিকা: ডিপথেরিয়া, হুপিংকফ, টিটেনাস, হেপাটাইটিস বি এবং হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি রোগ প্রতিরোধের জন্য।চ্চস্ফচস্রদ
  • হাম-রুবেলা টিকা (MR): হাম ও রুবেলা রোগ প্রতিরোধের জন্য।
  • নিউমোকক্কাল কনজুগেট ভ্যাকসিন (PCV): নিউমোনিয়া ও মেনিনজাইটিস রোগ প্রতিরোধের জন্য।
  • রোটাভাইরাস টিকা: ডায়রিয়া রোগ প্রতিরোধের জন্য।
  • হেপাটাইটিস বি টিকা: হেপাটাইটিস বি রোগ প্রতিরোধের জন্য।

টিকা গ্রহণ করা শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমরা সবাই টিকা নেই, তখন আমরা শুধু নিজেদের রক্ষা করি না, বরং অন্যদেরও রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখি। তাই, সময়মতো টিকা গ্রহণ করে সুস্থ জীবন নিশ্চিত করি।

তথ্যসূত্র:

  • বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)
  • গ্যাভি, দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স (GAVI, the Vaccine Alliance)
  • স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সরকার

লেখক

ডা কামরুল ইসলাম শিপু

চিকিৎসক ও গবেষক