From a Doctor

শরীরে সামান্য কাটা-ছেঁড়া থেকে একটি ভয়াবহ রোগ দেখা দিতে পারে যার নাম হচ্ছে টিটেনাস (Tetanus) । বাংলায় এ রোগকে ধনুষ্টংকার বলা হয়ে থাকে, কেননা এই রোগটি হলে শরীর ধীরে ধীরে  ধনুকের মতো বেঁকে যেতে পারে ।

ধনুষ্টংকার; কাটা-ছেঁড়া থেকে ভয়ংকর রোগ

শরীরে সামান্য কাটা-ছেঁড়া থেকে একটি ভয়াবহ রোগ দেখা দিতে পারে যার নাম হচ্ছে টিটেনাস (Tetanus) । বাংলায় এ রোগকে ধনুষ্টংকার বলা হয়ে থাকে, কেননা এই রোগটি হলে শরীর ধীরে ধীরে  ধনুকের মতো বেঁকে যেতে পারে ।

ঘরের বাইরে মাটি-ধুলো-বালিতে কিংবা মরচে-ধরা কোনো লোহার বস্তু দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে যদি আপনার শরীরের কোন অংশের চামড়া ছিলে যায় বা মাংসপেশি পর্যন্ত কোনো গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়, তবে সেই খোলা অংশের ভেতর দিয়ে অসংখ্য জীবানু আপনার শরীরে ঢুকে পড়ে । তার মধ্যে Clostridium tetani  (ক্লসট্রিডিয়াম টিটেনি) ব্যাকটেরিয়াটি মারাত্মক, যা কিনা ব্যাকটেরিয়াল স্পোর হিসেবে রাস্তা-ঘাটের ধুলো-বালিতে দীর্ঘদিন যাবৎ টিকে থাকে । এমনকি গরম-পানি, সাবান-পানি, সূর্যের তাপমাত্রা –কোনো কিছু দিয়েই এই স্পোরগুলিকে ধ্বংস করা যায় না । ফলে আমাদের শরীরের কোথাও একটু কেটে গেলেই এই জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে । এ থেকে বাঁচার একমাত্র সহজ উপায় হল- সময়মতো টিকা গ্রহণ করা ।

টিটেনাস দ্বারা আক্রান্ত হলে জ্বর, মাথা-ব্যাথা, আলো সহ্য করতে না পারা, মাংসপেশি বেঁকে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, হৃদযন্ত্রণা ইত্যাদি দেখা দিয়ে মানুষটির মৃত্যু ঘটে । তবে জন্মের পর ই. পি. আই. শিডিউলের প্রাথমিক টিকা ও এর পরবর্তি বুস্টার ডোজ সময়মতো নিয়ে থাকলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সমস্ত ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব । এ কারণে এইরূপ ভয়াবহ রোগের জন্য সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।

লক্ষণ ও উপসর্গ:

যেসব উপায়ে ব্যাকটেরিয়াটি আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারে –

  • কোথাও কেটে গেলে
  • চামড়া ছিলে গেলে
  • পশুর কামড়ে
  • দগ্ধ হলে
  • ইনজেকশন দিলে বা ট্যাটু করালে
  • নবজাতকের নাভিরজ্জুতে অপরিচ্ছন্ন কোনো সংস্পর্শে

ব্যাকটেরিয়া সফলভাবে একবার প্রবেশ করে ফেললে, টিটেনাসের লক্ষণগুলো ৪ – ২১ দিনের মতো সময় নিয়ে তারপর দেখা দিতে আরম্ভ করে । যার মধ্যে রয়েছে –

  • জ্বর ও মাথাব্যথা
  • মাংসপেশির আড়ষ্টতা, যা চোয়াল থেকে শুরু হয়ে ক্রমান্বয়ে ঘাড়, তারপর হাত, পেট, পিঠ ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
  • ঢোক গিলতে অসুবিধা
  • খিঁচুনি: আলো, শব্দ বা সামান্য নড়াচড়াতে মাংসপেশির তীব্র খিঁচুনি আরম্ভ হওয়া
  • মাংসপেশিগুলোর তীব্র সংকোচন –

লক জ: চোয়াল নাড়ানোর অক্ষমতা । এটি একটি বিশেষ অবস্থা যা চোয়ালের মাংসপেশির অতিরিক্ত সংকোচনের কারণে হয়ে থাকে ।

অপিস্থটোনাস কন্ডিশন: ঘাড় ও পিঠের মাংশপেশির তীব্র সংকোচনের ফলে পিঠ ধনূকের মতো বেঁকে যাওয়া । এ অবস্থায় অনেকসময় মেরুদণ্ডের হাড় ও ভেঙে যেতে পারে ।

রিসাস সারডনিকাস: মুখের মাংসপেশির সংকোচনে মুখমণ্ডল একটি বিকৃত রূপ ধারণ করে।

টিটেনাসের প্রতিরোধ কী করে সম্ভব?

টিটেনাস থেকে বাঁচার একমাত্র সহজ উপায় হচ্ছে সময়মতো টিকা গ্রহণ । এই টিকাটি বয়স ও ক্ষেত্র বিশেষে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে ধাপে ধাপে নিতে হয় ।

নবজাতকের ক্ষেত্রে: ই. পি. আই. শিডিউলের মাধ্যমে ৩ ডোজ পেন্টাভ্যালেন্ট ভেক্সিন (টিকা) সব শিশুর জন্মের ৬, ১০ ও ১৪ সপ্তাহ বয়সে দেয়া হয়ে থাকে, যা কিনা আরো ৪ টি রোগের সাথে টিটেনাসের বিরুদ্ধেও সুরক্ষা দেয় ।

১৫ বছর  বয়সী কিশোরীর ক্ষেত্রে: গর্ভকালীন ও নবজাতকে টিটেনাসের ঝুঁকি কমাতে ১৫ বছর বয়স থেকে শুরু করে মেয়েদের জন্য আরো ৫ ডোজ (শুধুমাত্র টিটেনাসের) ভেক্সিন দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে –

  • ১ম ডোজ: ১৫ বছর বয়সে বা তার উর্ধ্বে (৪৯ বছরের মধ্যে)
  • ২য় ডোজ: ১ম ডোজের ৪ সপ্তাহ পর
  • ৩য় ডোজ: ২য় ডোজের ৬ মাস পর
  • ৪র্থ ডোজ: ৩য় ডোজের ১ বছর পর
  • ৫ম ডোজ: ৪র্থ ডোজের ১ বছর পর

গর্ভবতীর ক্ষেত্রে: প্রেগনেন্সি সনাক্তকরণের পর যদি জানা যায় যে দূর্ভাগ্যক্রমে সেই মহিলার পূর্বে কোনো টিটেনাস বা ই. পি. আই. ভেক্সিন দেয়া হয় নি তবে তাকে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে টিটেনাসের ভেক্সিন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিতে হবে ।

সর্বসাধারণের ক্ষেত্রে: পর্যাপ্ত সুরক্ষা বজায় রাখতে ই.পি.আই শিডিউল ভেক্সিনেশনের পরও, ছেলে-মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রতি ১০ বছর পর পর টিটেনাস ভেক্সিনের একটি বুস্টার ডোজ নেয়াটা জরুরী ।

তাছাড়া রোড একসিডেন্ট বা লোহার বস্তু দ্বারা শরীরের যেকোন অংশে গভীর ক্ষত বা অল্প কাটা-ছেঁড়া, বাহ্যিক রক্তক্ষরণ হলেই টিটেনাসের একটি বুস্টার ডোজ ভেক্সিন, আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে যত দ্রুত সম্ভব নেয়া আবশ্যক । এক্ষেত্রে আঘাতটি যদি হালকা হয়ে থাকে এবং আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার আগে ৫ বছরের মধ্যে আপনার টিটেনাসের বুস্টার ডোজ দেয়া থাকে তাহলে আর অতিরিক্ত টিকা নেয়ার প্রয়োজন নেই ।

জটিলতা

টিটেনাস সংক্রমণের জটিলতাগুলির অন্তর্ভুক্ত :

শ্বাসকষ্ট– কণ্ঠনালী,ঘাড় এবং পেটের পেশী শক্ত হয়ে উঠার কারণে অনেকসময় প্রাণঘাতী শ্বাসকষ্ট দেখা দিতেপারে, বিশেষ করে  খিঁচুনির সময়।

ফুসফুসের ধমনীর বাধা (পালমোনারি এমবোলিজম)-শরীরের অন্যত্র তৈরি  হওয়া রক্তজমাট  ফুসফুসের প্রধান ধমনী বা এর যেকোনো শাখাকে ব্লক করতে পারে।

নিউমোনিয়া-ফুসফুসের সংক্রমণ শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় ফুসফুসে কোনোকিছু প্রবেশ করার মাধ্যমে হয়ে থাকে (অ্যাসপিরেশন নিউমোনিয়া) যা সাধারণত স্প্যাজম বা খিঁচুনির জটিলতার কারণ হতে পারে।

হাড়ভাঙ্গা–  খিঁচুনির কারণে  অনেকসময় মেরুদণ্ড বা অন্যান্য হাড় ভেঙে যেতে পারে।

মৃত্যুটিটেনাস আক্রান্তের প্রায়ই শ্বাসকষ্ট, হৃদস্পন্দন বা অন্যান্য অঙ্গের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুর ক্ষতি বা খিঁচুনিজনিত শ্বাসকষ্টের কারণে  মৃত্যু  ঘটে থাকে।

কখন ডাক্তার দেখাবেন

টিটেনাস একটি প্রাণঘাতী রোগ। আপনার যদি টিটেনাসের লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা সেবা নিন।

নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে চিকিৎসা সেবা নিন:

  • বিগত ১০ বছরের মধ্যে আপনি কোনো টিটেনাস টিকা নেননি।
  • আপনি শেষ কবে টিটেনাস টিকা নিয়েছিলেন তা নিয়ে নিশ্চিত নন।
  • আপনার চামড়া ফেটে/কেটে গেছে এমন ক্ষত, ক্ষতে ময়লা/ধূলা বালি/মাটির উপস্থিতি, পশুর কামড় বা একটি গভীর কাটা।
  • আপনার ক্ষত ময়লা, মাটি, মল, মরিচা বা লালা দ্বারা দূষিত – অথবা এই ধরনের এক্সপোজারের পরে পর্যাপ্তভাবে ক্ষত পরিষ্কার করেছেন কিনা তা নিয়ে আপনি সন্দিহান।
  • আপনার শেষ টিটেনাস শটের পর পাঁচ বা তার বেশি বছর হয়ে গেলে দূষিত ক্ষতগুলির জন্য একটি  বুস্টার টিকা নেয়ার প্রয়োজন।

তাছাড়া অনেক সময় টিটেনাসের টিকা দেয়ার পর তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বরূপ সেসকল স্থানে ব্যাথা,লাল হওয়া,ফুলে যাওয়া,জ্বর,গা-ব্যাথা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে ভয়ের কোনো কারণ নেই কেননা এগুলো সাধারনত আপনা-আপনিই সেরে যায়।

 

ডাক্তার কি করবেন ?

  • উপসর্গ বিহিন ক্ষত নিয়ে আসলে,

ডাক্তার যদি মনে করেন যে আপনার ক্ষত থেকে টিটেনাস হওয়ার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু এখনও কোন উপসর্গ দেখা যায়নি,তখন তিনি নিশ্চিত করবেন যে আপনার ক্ষত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিষ্কার করা হয়েছে কি না, তার পাশাপাশি যেসকল ক্ষতে মৃত টিস্যু রয়েছে ভালোভাবে সেসকল জায়গার অবনমন করতে হবে যাতে করে সেখানে ব্যাকটেরিয়া আশ্রয় নিয়ে কোনো ধরণের জটিলতা বৃদ্ধি করতে না পারে।এক্ষেত্রে অনেকসময়  টিটেনাস ইমিউনোগ্লোবুলিনের ইনজেকশনও দেয়া হয়ে থাকে।

  • উপসর্গ নিয়ে আসলে,

আপনার যদি টিটেনাসের লক্ষণগুলি দেখা দেয় তবে আপনাকে সাধারণত একটি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) ভর্তি করা হবে,যেখানে আপনাকে বিভিন্ন চিকিৎসা দেওয়া হবে।

সঠিক ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমেও টিটেনাসের  প্রতিকার সম্ভব

যেকোনো ধরনের কাঁটা বা ক্ষতের সর্বদা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিষ্কার এবং যত্ন নিতে হবে।

তাছাড়া পশুর কামড়, কোনো গভীর কাটা বা কাঁটায় কোন ধরণের বাইরের বস্তু বা ময়লা জমাট বাঁধতে দেখা গেলে অথবা কাঁটা জায়গা মাটি, মল, মরিচা পড়া কোনো লোহার বস্তু দ্বারা দূষিত থাকলে তাৎক্ষণিক ভাবে চিকিৎসা সেবা নিতে হবে । 

  • যদি আপনি নিশ্চিত না হন যে আপনি শেষ কবে টিটেনাস ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন বা কোর্স শেষ করেছিলেন কি না, তাহলে চিকিৎসা সেবা নিন।
  • আপনার শেষ টিটেনাস শটের পর পাঁচ বা তার বেশি বছর হয়ে গেলে দূষিত বা আরও গুরুতর ক্ষতের জন্য একটি সহায়ক(বুস্টার) টিকা নিতে হবে।

 

 

লিখেছেন,

নাজিফা ফারহাত হাই, এম বি বি এস স্টুডেন্ট

মালিহা জান্নাত, এম বি বি এস স্টুডেন্ট

 

রিভিউ করেছেন,

লিখেছেন,
ডা কামরুল ইসলাম শিপু
এম বি বি এস,
এম এস সি (ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজ)
দ্য ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা
ক্লিনিক্যাল রিসার্চ ফেলো ইন ভ্যাকসিনোলজি
দ্য ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড