প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রস্রাব বের হয়ে যাওয়া মোটামুটি কমন একটি সমস্যা। আমাদের মূত্রথলির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গেলে বা কোন কারণে নষ্ট হয়ে গেলে এ সমস্যা দেখা যায়। মেডিকেলের ভাষায় এটাকে ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স ( Urinary Incontinence) বলে।
সাধারণত এটি বয়স্ক মানুষের হয়ে থাকে। নিয়মিত সমস্যা হতে থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের জীবন যাত্রার কিছু পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এবং কিছু ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা করা সম্ভব।
ধরন ও লক্ষণসমূহঃ
এই সমস্যার বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে। প্রকারভেদ অনুসারে লক্ষণের কিছুটা পার্থক্য দেখা যেতে পারে।
- স্ট্রেস ইনকন্টিনেন্স (Stress incontinence) – আপনি যখন হাঁচি কাশি,শারীরিক ব্যায়াম, খুব ভারী কিছু তোলা বা খুব জোরে হাসেন, তখন অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রস্রাব বের হয়ে আসে।
- আর্জ ইনকন্টিনেন্স (Urge incontinence)-আপনার হঠাৎ করে খুব বেশি প্রস্রাবের চাপ আসবে এবং সাথে সাথে আপনি প্রস্রাব করে দিবেন। এটি সাধারণত ইনফেকশন বা ডায়াবেটিসের কারণে হতে পারে।
- ওভারফ্লো ইনকন্টিনেন্স (Overflow incontinence)-আপনার সব সময়ই কিছু না কিছু প্রস্রাব বের হতে থাকবে। কারণ আপনি যখন প্রস্রাব করতে চান মূত্রথলির দুর্বলতার কারণে একবারে সব প্রস্রাব বের করতে পারেন না।
- টোটাল ইনকন্টিনেন্স (Total Incontinence)- যখন আপনার মূত্রথলিতে কোন প্রস্রাব কিছু পরিমাণে ধরে রাখতে পারবেন না, তখন সারাদিন ধরে একটু একটু করে প্রস্রাব বের হতে থাকবে।
কারণসমূহঃ
বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন ধরনের প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারার সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমরা এই সমস্যাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা করব-
১. অস্থায়ী ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স এর কারণঃ
- অ্যালকোহল
- অতিরিক্ত চা-কফি পান করা
- অতিরিক্ত কার্বনেটেড পানীয় যেমন পেপসি, কোকাকোলা, সেভেন আপ ইত্যাদি পান করা
- চকোলেট
- যেসব খাবারে অতিরিক্ত মসলা, চিনি থাকে সেগুলো খাওয়া
- বেশি টক ফল যেমন কমলা, লেবু ইত্যাদি খাওয়া
- হার্টের এবং উচ্চ রক্তচাপের বিভিন্ন ঔষধ খাওয়া
- অতিরিক্ত পরিমাণ ভিটামিন সি খাওয়া
- মূত্রনালীর সংক্রমণ
- কোষ্ঠকাঠিন্য
২. স্থায়ী ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স এর কারণঃ
-
- গর্ভাবস্থা- হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে, এবং আপনার জরায়ুর বাচ্চার ওজন বাড়ার কারণে।
- প্রসবের পর-বাচ্চা ডেলিভারির সময় যোনিপথের আশেপাশের যেসব পেশি আপনার মূত্রথলিকে নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলো দুর্বল হয়ে যায়।
- বয়সের সাথে পরিবর্তন- বয়স বাড়ার সাথে সাথে মূত্রথলির প্রস্রাব ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায়।
- মেনোপজ- মেনোপজ বা (বয়সের কারনে)মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মহিলাদের ইস্ট্রোজেন নামক হরমোন কমে যায় যার কারণে মূত্রনালী দুর্বল হয়ে যায়।
- প্রোস্টেট বড় হয়ে যাওয়া- পুরুষদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিশেষ করে পঞ্চাশ বছরের পর প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হতে থাকে, এটাকে বিনাইন এনলার্জমেন্ট অফ প্রস্টেট বলা হয়।পুরুষদের ইনকন্টিনেন্স এর প্রধান একটি কারণ এটি।
- স্নায়বিক রোগ- বিভিন্ন স্নায়বিক রোগ যেমন স্ট্রোক, পারকিনসন্স ডিজিজ, ব্রেন টিউমার ইত্যাদির কারণেও এ সমস্যা হতে পারে।
- মূত্রথলির ক্যান্সার
- মূত্রথলির পাথর
কাদের বেশি হয়?
- পুরুষের তুলনায় মহিলাদের বেশি হয়
- বয়স বাড়ার সাথে সাথে রিস্ক বাড়তে থাকে
- যাদের ওজন বেশি
- যারা ধূমপান করেন
- যাদের এই রোগের পারিবারিক ইতিহাস আছে
- যারা ডায়াবেটিস বা কোন স্নায়ুবিক রোগে আক্রান্ত
কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
- স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন।এজন্য একটি পরিমিত খাদ্যাভ্যাস বা ব্যালেন্সড ডায়েট এবং ব্যায়াম করা জরুরি
- ‘পেলভিক ফ্লোর মাসল’ এর ব্যায়াম করুন। ইউটিউবে এই নাম লিখে সার্চ দিলেই ব্যায়াম করার সহজ পদ্ধতি শিখে ফেলতে পারবেন।
- অতিরিক্ত চা, কফি, মদ্যপান ইত্যাদি বর্জন করুন
- বেশি করে শাকসবজি খান
- ধূমপান বন্ধ করুন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের সাহায্য নিন।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
এই সমস্যা দেখা দেয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব একজন চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন। অনেকে লজ্জার কারনে এই বিষয়ে কথা বলতে চান না। সে ক্ষেত্রে মহিলারা সরাসরি একজন মহিলা গাইনোকোলজিস্টের কাছে যেতে পারেন ।
কিভাবে চিকিৎসা করা হয়?
প্রথমে চিকিৎসক কি কারনে আপনার সমস্যা হচ্ছে সেটি খুঁজে বের করবেন ।কারণ অনুসারে প্রধানত দুই ধরনের চিকিৎসা করা যায়-
১। সাধারণ চিকিৎসা-আপনার রোগের কারণ যদি আপনার জীবন যাত্রার সাথে জড়িত হয় তাহলে চিকিৎসক উপরে প্রতিরোধ করার জন্য যেসব পয়েন্ট বলা হয়েছে আপনাকে সেগুলো করতে বলবেন। এছাড়াও এই সমস্যার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রোডাক্ট বাজারে পাওয়া যায় যেমন ‘আবসর্বেন্ট প্যাড’ যেগুলো স্যানিটারি ন্যাপকিন এর মত পানি শুষে নেয়। আপনাকে খাওয়ার জন্য কিছু ঔষধ দেয়া হবে যেগুলো নিয়মমাফিক খেতে হবে।
২। সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা-আপনার শারীরিক পরীক্ষা করে এবং আপনার সমস্যার তীব্রতা দেখে চিকিৎসক আপনাকে সার্জারি করার কথাও বলতে পারেন।
সতর্কতাঃ যেহেতু বৃদ্ধবয়সে এই সমস্যা বেশি হয় তাই অনেকেই লজ্জায় কারো সাথে এটা নিয়ে কথা বলতে চান না। আপনি যদি মনে করেন আপনার বৃদ্ধ বয়সী বাবা-মা বা দাদা দাদি বা পরিবারের অন্য কেউ এই সমস্যায় ভুগছেন তাহলে তাদেরকে নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
আমাদের প্রতিটি লিখা চিকিৎসক দ্বারা লিখিত এবং সম্পাদিত। এই ওয়েবসাইটে চিকিৎসক/ডাক্তার বলতে নুন্যতম এম বি বি এস বা বি ডি এস ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের বোঝানো হয়। এই ওয়েবসাইটের সকল লেখা সচেতনতামূলক এবং চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়।