মুখের একপাশের মাংসপেশিসমূহ সাময়িকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা প্যারালাইস্ড হয়ে যাওয়ার সমস্যাকে বেল্স পাল্সি (Bell’s Palsy) বলা হয়ে থাকে। এর কারণে আপনার মুখের একপাশ ঝুলে পড়া, একদিকের চোখ বন্ধ করতে না পারা, মুখ দিয়ে অনবরত লালা পড়া ইত্যাদি নানান অস্বস্তিকর সমস্যাসমূহ একটি অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে।
পাল্সি শব্দের অর্থ হচ্ছে প্যারালাইসিস বা আড়ষ্টতা, এবং এই রোগের প্রথম যে বর্ণনাকারী- স্কটিশ এনাটমিস্ট, স্যার চার্লস্ বেল এর স্মরণে রোগটির এ নামকরণ।
এটি কোনো সংক্রামক ব্যাধি নয়, এবং সময়ের ব্যবধানে সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। তবে যে কোনো সময়, যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে এবং এর প্রতিরোধের কোনো ব্যাবস্থা নেই। সেজন্য এ বিষয়ে সচেতনতা এবং সামাজিক ও পারিবারিক সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সময়মতো চিকিৎসকের নিকট পরামর্শ নিতে পারলে বেল্স পাল্সি থেকে কোনো ধরণের জটিলতা ছাড়াই দ্রুত সুস্থতা লাভ করা সম্ভব।
লক্ষণ :
বেল্স পাল্সি যে কোনো বয়সের, নারী-পুরুষ, যে কাউকে আঘাত করতে পারে। তবে দেখা গেছে সাধারণত ১৬-৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে এর প্রকোপ বেশি হয়ে থাকে।
উপসর্গগুলো প্রথমে আকস্মিকভাবে দেখা দেয়; কারো ক্ষেত্রে সামান্য কানে ব্যাথা থেকে শুরু হতে পারে, কারো বা ঠোঁটের এক কোণ অবশ লাগা কিংবা একপাশের চোখ দিয়ে অকারণে পানি পড়া থেকে শুরু হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে সেই একপাশ থেকে আরো অনেক সমস্যা দেখা দিতে আরম্ভ করে, যথা-
- চোখের পাতা ও মুখের একপাশ ঝুলে পড়া
- খাওয়া, পান করা ও কথা বলতে অসুবিধা বোধ করা
- ক্ষতিগ্রস্ত দিকের চোখ বন্ধ করার অক্ষমতা
- মুখের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা, যেমন- হাসা, ভ্রুকুটি, চোখের পলক ফেলায় অক্ষমতা
- মুখ দিয়ে লালা পড়া বা মুখের ভেতর বারবার শুকিয়ে যাওয়া
- চোখে জ্বালাপোড়া, শুষ্কতা কিংবা অনবরত চোখ দিয়ে পানি পড়া
- হাসতে গেলে বা কথা বলতে গেলে ঠোঁট একদিক দিয়ে বেঁকে যাওয়া
- মাথা, কান কিংবা চোয়ালের আশেপাশে ব্যাথা
- ক্ষতিগ্রস্ত দিকের বলিরেখা সমূহ মিলিয়ে যাওয়া
- আপনার মুখের সম্পূর্ণ একপাশের মাংসপেশির দুর্বলতা ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়া, যা কিনা ৭২ ঘন্টার মধ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকে।
পক্ষাঘাত কেবল মুখমণ্ডলের যে কোনো একপাশ (বিরল ঘটনায় মুখের দু-পাশ) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে, শরীরের অন্য কোথাও ছড়ানোর কোনো ঝুঁকি থাকবে না।
বেল্স পাল্সি কী কারণে হয়?
আমাদের মুখমণ্ডলের স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী হচ্ছে দু-জোড়া ফেসিয়াল নার্ভ বা স্নায়ু (মস্তিষ্কের ৭ম ক্রেনিয়েল নার্ভ)। করোটির ভেতর কানের নিচের দিকের দু-পাশের সরু দুটি ছিদ্র দিয়ে নেমে এসে, নার্ভটি আমাদের মুখের মাংসপেশিসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেকোনো একপাশের নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলেই মুখের সেই পাশে পক্ষাঘাত বা বেল্স পাল্সি দেখা দেয়।
তবে নার্ভটি কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সে বিষয়টির সঠিক কারণ এখনো অজানা। বেশিরভাগ চিকিৎসা গবেষক মনে করেন এটি সম্ভবত একটি ভাইরাল সংক্রমণের দ্বারা সৃষ্ট। তাদের মতে, ভাইরাল সংক্রমণের প্রদাহজনিত কারণে আমাদের একপাশের ফেসিয়াল নার্ভ ফুলে যায়, যার কারণে, ফুলে যাওয়া নার্ভকে তখন করোটির সেই সরু ছিদ্রের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে থাকতে হয়। ফলে, নার্ভটি সঠিকভাবে কাজ করতে বাঁধাগ্রস্ত হয়। প্রদাহ কমে গেলে আস্তে আস্তে এ ক্ষয়ক্ষতি কমে আসে এবং আবার আগের মত সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়।
যেসব ভাইরাসের কারণে বেল্স পাল্সি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে-
- হারপিস সিম্প্লেক্স
- হারপিস জোস্টার
- সাইটোমেগালোভাইরাস
- এপ্স্টাইন বার
- শ্বাসযন্ত্রের অসুবিধাজনিত ভাইরাস, যথা- ইনফ্লুয়েঞ্জা বি, এডেনোভাইরাস
- মাম্পস্
ঝুঁকিতে যারা:
- গর্ভবতী নারী
- ডায়াবেটিস্ আছে যাদের
- ফুসফুসে ইনফেকশন আছে যাদের
- ফ্যামিলি হিস্ট্রি থাকলে
স্থায়িত্বকাল:
কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাসের (সাধারণতঃ ২সপ্তাহ -৯মাসের) মধ্যেই বেল্স পাল্সি হতে সম্পূর্ণ সুস্থতা লাভ করা সম্ভব। নার্ভের ক্ষতির তীব্রতার উপর নির্ভর করে এর স্থায়িত্বকাল কম-বেশি হতে পারে। কারো কারো ১-২ বছর যাবৎ মুখের দুর্বলতা থেকেই যায়। সময়মতো চিকিৎসার অভাবে আরো বেশি সময়ও লাগতে পারে এবং বিভিন্ন জটিলতাও দেখা দিতে পারে। বিরল কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, সুস্থতার কয়েক বছর পর, উপসর্গগুলি ফিরে আসতে পারে কিংবা স্থায়ীও হয়ে যেতে পারে।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
যেকোনো ধরণের আড়ষ্টতা বা অসাড়তা অনুভব করলে অবিলম্বে ডাক্তার দেখানো জরুরী, কেননা আপনার ব্রেন-স্ট্রোকের জন্যেও এমন হতে পারে। বেল্স পাল্সি স্ট্রোকের কারণে হয় না, কিন্তু এটি একই ধরণের উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে।
উপরোল্লিখিত উপসর্গ কয়েকটা একসাথে দেখা দিলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
উপসর্গ দেখা দেয়ার ৭২ ঘন্টার মধ্যে সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার ফলে অনেকের ক্ষেত্রেই অনেক কম সময়ের মধ্যে সুস্থতা লাভ করার দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ রয়েছে।
চিকিৎসক যা করবেন:
চিকিৎসক আপনার সমস্যাসমূহ শুনবেন, দেখবেন ও পরীক্ষা করবেন। আপনার লক্ষণগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন, সেগুলি কখন ঘটেছিলো বা কখন আপনি প্রথম তা লক্ষ্য করেছিলেন– এই ধরণের প্রশ্ন। আপনার মুখের পেশিগুলোর দুর্বলতার মাত্রা নির্ধারণ করতে ডাক্তার কিছু শারীরিক পরীক্ষা করতে পারেন।
বেল্স পাল্সি সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন রকম পরীক্ষা লাগতে পারে, যেমনঃ ভাইরাল বা ব্যাক্টেরিয়াল সংক্রমণ নির্ণয়ের জন্য- রক্ত পরীক্ষা, নার্ভের ক্ষতি নির্ধারণের জন্য- এম আর আই, সি টি-স্ক্যান, ইত্যাদি।
চিকিৎসক ঔষধের নাম দিয়ে দিতে পারেন।
ডাক্তার আরো পরামর্শ দিতে পারেন- ঘুমানোর সময় চোখকে বন্ধ রাখার জন্য, চোখে আই-প্যাচ (eye patch) লাগিয়ে ঘুমানো, প্রয়োজনানুসারে মুখের মাংসপেশি ঠিক রাখার জন্য ফিজিয়োথেরাপি নেয়া ইত্যাদি।
সম্ভাব্য জটিলতা:
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেল্স পাল্সি রোগীর কোনো ধরণের জটিলতা ছাড়াই, সাশ্রয়ী চিকিৎসায়, সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হওয়া সম্ভব।
কিন্তু কারো কারো গুরুতর ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতেই পারে।এরমধ্যে নিম্নলিখিতগুলো উল্লেখযোগ্য-
- আপনার চোখে অতিরিক্ত শুষ্কতা থাকতে পারে, যা চোখের ইনফেকশন, আল্সার এমনকি অন্ধত্বের কারণও হতে পারে।
- আপনার সিনকাইনেসিস হতে পারে, যা হল এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীরের একটি অংশ নাড়াচাড়া করলে অন্যটি অনিচ্ছাকৃতভাবে সরে যায়।
উদাহরণস্বরূপঃ আপনি হাসলে সেই সাথে আপনার চোখও আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
- হতাশা ও বিষন্নতা বেল্স পাল্সি রোগীদের ঘিরে ধরতে পারে।
একজন সুস্থ সবল মানুষকে হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়া দীর্ঘদিন বিকৃত একটি চেহারা নিয়ে সমাজে চলা ফেরা করতে হলে তার হতাশায় ভোগাটাই স্বাভাবিক। সাময়িক কিছু দিনের জন্য হলেও সে এখন আর হাসতে পারে না, নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখতে পারে না, খেতে পারে না ঠিকমত- এ অবস্থায় তার আশেপাশের মানুষ ও পরিবার-পরিজনকে এগিয়ে এসে তাকে ভরসা দিতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে। তাকে আশ্বাস দিতে হবে যে এই সমস্যাগুলো সাময়িক, আর কটা দিন পরেই সে আবার আগের মত সুস্থতা ফিরে পাবে এবং এজন্য তাকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শগুলো গুরুত্ব দিয়ে পালন করতে হবে, পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনও ঠিকমত চালিয়ে যেতে হবে।
ছবিঃ মায়ো ক্লিনিক।
লিখেছেন,নাজিফা ফারহাত হাই, মেডিক্যাল স্টুডেন্টরিভিউ করেছেন,ডা সালেহা আফরিন বৃষ্টি , এম বি বি এস