From a Doctor

সিজারিয়ান ডেলিভারি; কেন করা হয়, সুবিধা ও অসুবিধা

সিজারিয়ান ডেলিভারি; কেন করা হয়, সুবিধা ও অসুবিধা

বাংলাদেশের প্রায় সব মহিলাই সিজারিয়ান ডেলিভারি বা সিজার নামটি সম্পর্কে অবহিত! সি-সেকশন নিয়ে অনেকের মনেই হরেক রকমের প্রশ্ন থাকে। কিন্তু তেমন প্রচারণা না থাকায় এ বিষয়ে বেশিরভাগ মায়েদের স্পষ্ট ধারণা নেই। আবার অনেকেই মনে করেন চিকিৎসকরা নিজের ইচ্ছা মতো সিজারিয়ান ডেলিভারি করতে পারেন!

 

তাই এ বিষয়ে বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে যথাযথ সচেতনতা গড়ে তুলাটা সময়ের দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

সিজারিয়ান ডেলিভারি কি এবং কেন করা হয়?

সি-সেকশন হলো এমন একটি পদ্ধতি যেখানে যোনিপথের বদলে  মায়ের পেট এবং জরায়ুতে ছেদের মাধ্যম বাচ্ছার জন্ম দেয়া হয়ে থাকে! জেনে রাখা দরকার যে চাইলেই সি-সেকশন করা উচিত নয়। যদি গর্ভবতী মহিলার স্বাভাবিক প্রসবের সময় মা অথবা শিশুর জীবনের ঝুঁকি থাকে, তখন একজন চিকিৎসক পূর্বপরিকল্পিতভাবে সিজারিয়ান অপারেশনের আশ্রয় নিয়ে থাকেন ।

যদি আপনার চিকিৎসক নিম্নলিখিত বিষয় গুলো সম্পর্কে আপনাকে অবগত করেন তখন আপনার সি-সেকশন করা লাগতে পারে: 

  •  শিশুর অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়া (ইমার্জেন্সি সি-সেকশন) 
  •  প্রসবের জন্য অনুপযোগী যোনিপথ
  • বাচ্ছার পা প্রথমে বের হয়ে গেলে (ব্রীচ পজিশন)
  • প্রসব জনিত উচ্চরক্তচাপ (প্রি-এক্লাম্পসিয়া)
  • প্লাসেন্টা জনিত জটিলতা :

                  * প্লাসেন্টা প্রিভিয়া – এখানে প্লাসেন্টা জরায়ুর খোলা অংশকে আবৃত করে রাখে।

                  * প্লাসেন্টা এক্রেটা -প্ল্যাসেন্টা জরায়ুর প্রাচীরের গভীরে বৃদ্ধি পায়।

[বি:দ্র: প্লাসেন্টা হচ্ছে প্রসূতি মায়ের শরীরে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা গর্ভবতী মহিলার জরায়ুতে শিশুকে অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করতে এবং শিশুর রক্ত ​​থেকে বর্জ্যগুলি অপসারণ করতে সাহাযা করে।]

    

  • কিছু সংক্রামক ব্যাধি থাকলে যেমন : HIV বা হার্পেস 
  • শিশুর মাথা খুব বড় হলে (ম্যাক্রোসেফালি)
  • সাধারণত মায়ের দুইটার বেশি সিজারিয়ান অপারেশন হলে
  • যদি মায়ের জরায়ুতে বড় ফাইব্রয়েড থাকে যা বাচ্ছার প্রসবে বাধা দেয়
  • প্রসবের শ্রমের অগ্রগতি না হলে

 

কিছু মহিলাগণ কোনো মেডিকেলীয় কারণ ছাড়াই সিজারিয়ান ডেলিভারি করাতে চান। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সিজারিয়ান ডেলিভারির সাথে যোনিপথের প্রসবের পার্থক্য,  সুবিধা এবং অসুবিধা মায়ের কাছে বর্ণনা করে দিবেন। 

 

সিজারিয়ান অস্ত্রপাচারের আগে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী নিচের কাজগুলো করা উচিত:

 

  • রক্ত পরীক্ষা 
  • একটি এনেস্থেশিয়ার ফিটনেস পরীক্ষা 
  • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া
  • অস্ত্রোপচারের আগে চিকিৎসকের উপদেশগুলি মেনে চলা

 

সেরে উঠবেন কখন?

সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের পর সাধারণত ৩/৪ দিন হাসপাতালে থাকতে হয় যেখানে যোনিপথের প্রসবের ক্ষেত্রে ১/২ দিনের মধ্যেই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে পারবেন। তাছাড়া পেটের যে অংশে অপারেশন করা হবে সেখানে একটি দাগ থেকে যায় যা সময়ের সাথে কিছুটা কমে যাবে।

 

সম্পূর্ণ সেরে উঠতে ৬-৮ সপ্তাহের মত সময় লাগতে পারে।

 

ঝুঁকিসমূহ:

 

সাধারণত এটি একটি নিরাপদ পদ্ধতি। তবে যেকোনো ধরণের অস্ত্রোপচারেই কিছু ঝুঁকি থেকে থাকে।

অনেকের ধারণা থাকে যে সিজারিয়ান সেকশন করলে ব্যাথা কম হবে, সময় কম লাগবে। কিন্তু যথাযথ কারণ না থাকলে নরমাল ডেলিভারির বদলে সিজারিয়ান ডেলিভারি করলে যেসকল জটিলতাগুলা হতে পারে তা সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। সম্ভাব্য ঝুঁকিসমূহ হল – 

১. কাটা জায়গায় ইনফেকশন

২.রক্ততঞ্চন 

৩. অতিরিক্ত রক্তপাত

৪.জরায়ুর আশেপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো যেমন মূত্রথলি বা মূত্রনালিতে আঘাত হওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি। 

 

সিজার পরবর্তী গর্ভধারণ : 

আপনার যদি সি-সেকশনের মাধ্যমে বাচ্চা হয়, তাহলে এর মানে এই নয় যে ভবিষ্যতে আপনার যে কোনো বাচ্চা এইভাবে প্রসব করতে হবে।

অনেক মহিলা যাদের সিজারিয়ান সেকশন হয়েছে তারা নিরাপদে তাদের পরবর্তী শিশুর জন্য যোনিপথে প্রসব করতে পারে, যা Vaginal Birth After Caesarean (VBAC)  হিসাবে পরিচিত।

তবে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য আপনাকে প্রসবের সময় কিছু অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হতে পারে।

তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত একজন  মহিলার যদি প্রথম বাচ্ছা সি-সেকশনে হয় তাহলে তাদের অন্য বাচ্ছার জন্যও সিজারিয়ান ডেলিভারি করার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।

এই সিদ্ধান্তটি মা এবং তার শিশুর জন্য একটি সিজারিয়ান ডেলিভারি  সবচেয়ে নিরাপদ বিকল্প কিনা তার উপর নির্ভর করে।

অপারেশনের পর করণীয়: 

সিজারিয়ান অপারেশনের পর মহিলাদের নিজের বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত।

  • আদর্শভাবে, অস্ত্রোপচারের এক ঘণ্টার মধ্যে বা তার পরেই বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করতে হবে। মাকে ৬ মাস ধরে শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো সম্পর্কে শেখানো হয়।
  • মাকে প্রচুর জল এবং অন্যান্য তরল পান করতে হবে।
  • অস্ত্রোপচারের পরে, যদি মা নিজে কিছু খেতে বা পান করতে না পারেন, তাহলে IV এর মাধ্যমে তরল দেওয়া যেতে পারে।
  • সম্পূর্ণ সেরে উঠার জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া অপরিহার্য যা ভবিষ্যতের জটিলতা কমাতে সাহায্য করে।
  • চিকিৎসকের পরামর্শানুযায়ী ওষুধ সেবন করা উচিত।
  • ক্ষত পরিষ্কার এবং শুকনো রাখুন।
  • বাড়িতে যাওয়ার পর চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুসরণ করুন এবং নিয়মিত বা কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে ডাক্তারের কাছে যান।

 

সি-সেকশনের সুবিধা:

 

২০১৭-১৮ সালের বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এন্ড হ্যালথ সার্ভে ডাটা অনুযায়ী আমাদের দেশে সি-সেকশনের রেট ছিল ৩৩% এবং ২০১৯ সালে তা হয়ে দাঁড়ায় ৩৬%। এই ক্রমশ বৃদ্ধির পিছনে বিভিন্ন কারণ দায়ী রয়েছে।গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে মায়ের উচ্চতা,ওজন,মায়ের শরীরে রক্তের পরিমাণ, উচ্চরক্তচাপ, ডায়েবেটিস ইত্যাদি ব্যাধি আছে কিনা এবং আরো বিভিন্ন বিষয়ের উপর। সি-সেকশনের সুবাদে বর্তমানে আমাদের দেশের প্রসূতি মায়েদের মৃত্যুর হার অনেকাংশেই কমে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, বরং প্রসবের সময় শিশু মৃত্যুর হারও কমে এসেছে অনেক। তবে হ্যাঁ, সুষ্ট জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনে সি-সেকশনের হার বেড়ে চলছে।

যথেষ্ট সচেতনতা এবং মায়েদের যথাযথ নেতৃত্ব দিয়ে অপ্রয়োজনে সি-সেকশনের পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। 

 

লিখেছেন,

ডা. সালেহা আফরিন বৃষ্টি

এম বি বি এস