From a Doctor

নিপাহ; খেজুরের রসে প্রানঘাতী ভাইরাস

নিপাহ; খেজুরের রসে প্রানঘাতী ভাইরাস

নিপাহ ভাইরাস (NiV) একটি জুনোটিক ভাইরাস (এটি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয়) এবং এটি দূষিত খাবারের মাধ্যমে বা সরাসরি মানুষের মধ্যে সংক্রমণ হতে পারে। সংক্রামিত ব্যক্তিদের মধ্যে, এটি উপসর্গবিহীন (সাবক্লিনিকাল) সংক্রমণ থেকে তীব্র শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা এবং মস্তিস্কের মারাত্মক ইনফেকশন পর্যন্ত বিভিন্ন রোগের কারণ হয়।

নিপাহ ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া

 নিপাহ ভাইরাস এশিয়ায় কয়েকটি প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছে। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার সুঙ্গাই নিপাহ গ্রামে শূকর চাষীদের মধ্যে  প্রথম দেখা যায়। ১৯৯৯ সালে, মালয়েশিয়ার একটি খামার থেকে আমদানি করা শূকরের সাথে যুক্ত ১১  জন গোয়ালঘর কর্মী সহ সিঙ্গাপুরে আরেকটি প্রাদুর্ভাব ঘটে যেগুলি নিপাহ দ্বারা সংক্রমিত হয়েছিল ।

প্রাথমিক সনাক্তকরণের পর থেকে, তিনটি দেশে একক বা বিক্ষিপ্ত প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছে : বাংলাদেশ (প্রথম প্রাদুর্ভাব ২০০১ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর, ভারতে (২০০১, ২০০৭, ২০১৮, ২০১৯, ২০২১) এবং ২০১৪ সালে ফিলিপাইন। 

বাংলাদেশ এবং ভারতে সংক্রমণের সবচেয়ে সম্ভাব্য উৎস ছিল ফল এবং  কাঁচা খেজুরের রস। মানুষ-থেকে-মানুষেও সংক্রমণও হয়েছে। 

ফিলিপাইনে, মানুষের মধ্যে সংক্রমণের কারন ছিলো সংক্রামিত ঘোড়ার সরাসরি সংস্পর্শ, অসুস্থ ঘোড়া জবাই করা,সংক্রামিত ঘোড়াগুলি থেকে কাঁচা বা কম রান্না করা মাংস খাওয়া।

বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, নিউ ক্যালেডোনিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম এসব দেশে ফলের বাদুরগুলোতে অ্যান্টি-এনআইভি বা ক্রস-রিঅ্যাক্টিং অ্যান্টি-এনআইভি অ্যান্টিবডি সনাক্ত করা হয়েছে। 

geocraphical-distribution-nipah
নিপাহ ভাইরাসের বাহক বাদুরের ভৌগলিক অবস্থান। ছবিঃ ওয়ার্ল্ড হেলথ ওর্গানাইজেশন

কিভাবে ছড়ায় 

  • সংক্রামিত প্রাণী থেকে সরাসরি, যেমন বাদুড় বা শূকর, বা তাদের শরীরের তরল (যেমন রক্ত, প্রস্রাব বা লালা)
  • সংক্রামিত প্রাণীর দেহের তরল দ্বারা দূষিত খাদ্য পণ্য গ্রহণ করা (যেমন খেজুরের রস বা সংক্রামিত বাদুড় দ্বারা দূষিত ফল)
  • আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে বা তাদের শরীরের তরল (হাচি, কাশি, লালা, সর্দি, প্রস্রাব বা রক্ত ) ইত্যাদির মাধ্যমে

Pteropodidae পরিবারের ফলের বাদুড় – বিশেষ করে Pteropus গণের অন্তর্গত প্রজাতি – নিপাহ ভাইরাসের প্রাকৃতিক হোস্ট। 

অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি, থাইল্যান্ড এবং তিমুর এসব দশে এই বাদুর দেখা যায়।

লক্ষণ ও উপসর্গ

নিপাহ ভাইরাস (NiV) এর সংক্রমণের ফলে মস্তিষ্কের ফুলে যাওয়া (এনসেফালাইটিস) এবং সম্ভাব্য মৃত্যু সহ হালকা থেকে গুরুতর রোগ হতে পারে।

লক্ষণগুলি সাধারণত ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার ৪-১৪ দিনের মধ্যে প্রদর্শিত হয়। 

লক্ষণগুলির মধ্যে প্রাথমিকভাবে নিম্নলিখিতগুলির একটি বা একাধিক অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:

  • জ্বর
  • মাথাব্যথা
  • কাশি
  • গলা ব্যথা
  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
  • বমি

গুরুতর লক্ষণ-

  • বিভ্রান্তি, তন্দ্রা বা বিভ্রান্তি
  • খিঁচুনি
  • কোমা
  • মস্তিষ্কের ফুলে যাওয়া (এনসেফালাইটিস)

৪০-৭৫% ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটতে পারে। 

নিপাহ

                                                                                                  উৎস: বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় *১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত

 

নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে, যার মধ্যে খিঁচুনি এবং মানসিক পরিবর্তন রয়েছে।

কখনও কখনও এক্সপোজারের পরে অনেক পরে মৃত্যু হয় যা এক মাস থেকে শুরু করে ১ বছর পরও হতে পারে।

কিভাবে রোগ নির্নয় করা যায়?

নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ রোগের তীব্রতা , রোগীর কাছ থেকে রোগের বর্ননা, সাম্প্রতিক এক্সপোজার এর ঘটনা (যেমন খেজুরের রস খাওয়া) রোগ নির্নয়ে সাহায্য করে। 

ব্যবহৃত প্রধান পরীক্ষাগুলি রিয়েল টাইম পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (RT-PCR) এবং এনজাইম-লিঙ্কড ইমিউনোসর্বেন্ট অ্যাসে (ELISA)।

চিকিতসাঃ

  • বর্তমানে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের জন্য কোন লাইসেন্সকৃত চিকিত্সা নেই। 
  • বিশ্রাম, পানি পান এবং উপসর্গ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে সে অনুযায়ী সহায়ক যত্নের মধ্যে চিকিত্সা সীমাবদ্ধ।
  • ইমিউনোথেরাপিউটিক চিকিত্সা (মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপি) রয়েছে যা নিয়ে পরীক্ষা নিরিক্ষা চলছে।

মানুষের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করা

মানুষের মধ্যে সংক্রমণ কমাতে বা প্রতিরোধ করার একমাত্র উপায় হল ঝুঁকির কারণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

  • বাদূর থেকে মানুষে সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করা।
    কোনভাবেই কাচা খেজুরের রশ খাওয়া যাবে না। তাজা সংগ্রহ করা খেজুরের রস সিদ্ধ করতে হবে । খাওয়ার আগে ফল ভালোভাবে ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। বাদুড়ের কামড়ের চিহ্নযুক্ত ফল ফেলে দিতে হবে।
  • প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করা
    গ্লাভস এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরা উচিত অসুস্থ প্রাণী ধরাছোয়া করার সময়।
  • মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করা
    নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিচর্চা করার সময় মাস্ক, গ্লাভস পড়তে হবে এবং বার বার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। 
  • স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্টানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা

বাংলাদেশ এবং ভারতে অনেক চিকিতসক ও নার্স নিপাহ রোগীদের চিকিতসা দিয়ে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে মৃত্য বরন করেছেন। দেশে যেসব এলাকায় নিপাহ প্রবনতা বেশি সেসব এলাকায় নিপাহ রগের লক্ষনযুক্ত রোগী মূল হাসপাতালে নেয়ার আগে প্রাথমিক স্ক্রিনিং সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া উচিত।

রেফারেন্সঃ

 

লিখেছেন,
ডা কামরুল ইসলাম শিপু
এম বি বি এস
এম এস সি (ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজ)
দ্য ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা
ক্লিনিক্যাল রিসার্চ ফেলো ইন ভ্যাকসিনোলজি
দ্য ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড

আমাদের প্রতিটি লিখা চিকিৎসক দ্বারা লিখিত ও সম্পাদিত। এই ওয়েবসাইটে চিকিৎসক বলতে নুন্যতম এম বি বি এস ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের বোঝানো হয়। এই ওয়েবসাইটের সকল লেখা সচেতনতামূলক এবং চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়