From a Doctor

বিষাক্ত সাপের কামড়- পরিচিতি,চিকিৎসা ও প্রতিকার

বিষাক্ত সাপের কামড় – পরিচিতি,চিকিৎসা ও প্রতিকার

বাংলাদেশে প্রতি বছর ৭ লাখ এর বেশি মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়। এদের মধ্যে বছরে মারা যায় ৬ হাজার এর বেশি মানুষ ।

 সাপের কামড় বেশি হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাস পর্যন্ত। কারন এই সময় বৃষ্টি হয়, আর সাপ যে গর্তে থাকে তা পানিতে ডুবে যায়। সাপ তখন শুকনো জায়গা খুঁজে বেড়ায়। এই জন্য মানুষের বাড়ীতে আসে। বিশেষ করে শুকনো জায়গা যেমন-খড়ের গাদা, কাঠের বা খড়ির স্তুপ, বিছানা এমনকি বালিশের নিচেও আশ্রয় নিতে পারে

বাংলাদেশে ৪ ধরনের বিষাক্ত সাপের কামড় সাধারণত বেশি পাওয়া যায়-

১) গোখরো ( Spectacled cobra )

গোখুরা সাপ, বাংলাদেশের বিষাক্ত সাপ
গোখুরা সাপ, বাংলাদেশের বিষাক্ত সাপ

২) কেউটে (Monocled cobra )

কেউটে, বাংলাদেশের বিষাক্ত সাপ

কেউটে, বাংলাদেশের বিষাক্ত সাপ

৩) চন্দ্রবোড়া (Russell’s viper )

চন্দ্রবোড়া,বাংলাদেশের বিষাক্ত সাপ
চন্দ্রবোড়া,বাংলাদেশের বিষাক্ত সাপ

৪) কালাচ (Common krait )

কালাচ, বাংলাদেশের বিষাক্ত সাপ
কালাচ, বাংলাদেশের বিষাক্ত সাপ

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত।

 

সাপের কামড় কি বিপজ্জনক?

সাপের কামড়ের দুটি ভিন্ন ধরনের আছে। একটি অন্যটির চেয়ে বেশি গুরুতর:

  • শুকনো কামড়: সাপ তার কামড়ের সাথে কোন বিষ মুক্ত করে না। এগুলি বেশিরভাগই অ-বিষাক্ত সাপের হয়
  • বিষাক্ত কামড়: এগুলো অনেক বেশি বিপজ্জনক। সাপ কামড়ানোর সময় বিষ ঢেলে দেয়

বিষাক্ত সাপ কামড়ালে বেশিরভাগ সময় বিষ ঢেলে দেয়। তারা নিঃসৃত বিষের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং ৫০ থেকে ৭০ ভাগ বিষধর সাপের কামড়ের ফলে বিষক্রিয়া হয়। 

বিষের ধরনঃ 

বিষাক্ত সাপের বিভিন্ন প্রজাতি বিভিন্ন ধরনের বিষ বহন করে। 

হেমোটক্সিনঃ  রক্তের লোহিত কণিকাকে বিভক্ত করে অথবা রক্তের জমাট বাঁধার ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে।

নিউরোটক্সিনঃ নার্ভকে আক্রান্ত করে, যার ভয়াবহ পরিণতি হল যেসব পেশীর সংকোচন প্রসারণে আমরা খাবার গিলতে পারি বা নিঃশ্বাস নিতে পারি – সেগুলি অকেজো হওয়া।

কার্ডিওটক্সিনঃ এটি হৃদ্-যন্ত্রকে সরাসরি আক্রমণ করে এবং রক্ত-চলাচল বন্ধ করে দিতে পারে।

সাইটোটক্সিনঃ কামড় এর জায়গায় ও আশেপাশে খুব বেশি  ফুলে যায়।

মায়োটক্সিন: মাংশপেশীর ক্ষতি করে এবং প্রচন্ড ব্যাথা করে।

 

লক্ষণসমূহঃ 

সাপ হয় শিকার ধরতে বা আত্মরক্ষার জন্য কামড়ায়। কিন্তু যেহেতু বিষাক্ত এবং অ-বিষাক্ত ধরণের সাপ রয়েছে – প্রতিটি সাপের কামড়ে লক্ষন সমানভাবে তৈরি হয় না

সাপ কামড়ালে নিচের লক্ষণগুলি প্রকাশ পেতে পারে :

  •  ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়া 
  •  চামড়াতে সাপের দাঁতের দাগ এবং সেই জায়গাটা ফুলে যাওয়া • দংশনের জায়গাতে তীব্র যন্ত্রণা 
  • জ্বালা ভাব
  • অস্বাভাবিক রক্ত ​​জমাট বাঁধা বা রক্তপাত। 
  •  সংজ্ঞাহীন হয়ে যাওয়া 
  • মাথা ঘোরা 
  • পেট খারাপ হওয়া
  •  চোখে ঝাপসা দেখা 
  •  অত্যাধিক ঘাম হওয়া 
  • গলা শুকিয়ে যাওয়া
  •   জ্বর 
  •  বমি ভাব বা বমি হওয়া
  •   অসাড়তা বা ঝিঁ-ঝিঁ ধরা 
  •  নাড়ীর গতি বেড়ে যাওয়া
  •  মুখ দিয়ে লালা ঝরা
  •   খিঁচুনী 
  •  শ্বাস কষ্ট এবং বুকে ঘড় ঘড় শব্দ করা 
  •  ক্ষতস্থানের চারদিক নীল হয়ে যাওয়া কিম্বা কালচে হয়ে যাওয়া
কোন সাপ বিষাক্ত?

বিষাক্ত সাপের দুটি প্রধান দল রয়েছে:

১.   কোবরা পরিবার বা এলাপিডস: প্রায়  ৩০০ টি বিষাক্ত প্রজাতি রয়েছে , যার মধ্যে রয়েছে ক্রেট, মাম্বা, প্রবাল সাপ এবং সামুদ্রিক সাপ প্রধান । এদের উপরের চোয়ালের সামনের অংশে ছোট ফ্যাংস থাকে । তাদের বিষ প্রধানত নিউরোটক্সিক ন। যদি কোবরা আপনাকে কামড়ায়, তবে কামড়ের পরে আপনি খুব দ্রুত হৃদপিণ্ড এবং ফুসফুসের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে মারা যেতে পারেন

২.   ভাইপার পরিবার : এর ২০০ টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পিট ভাইপার (যেমন র‍্যাটলস্নেক, কপারহেড, ওয়াটার মোকাসিন বা কটনমাউথ) এবং ওল্ড-ওয়ার্ল্ড ভাইপার (অ্যাডার)। তাদের উপরের চোয়ালের চলমান হাড়ের সাথে লম্বা, ফাঁপা, বিষাক্ত ফ্যাংস থাকে। 

 

সাপ কামড়ালে প্রথমে কি করবেন?

সাপ কামড়েছে জানলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। সাথে সাথে আপনার যা করনীয় –

  • স্থির এবং শান্ত থাকুন। যদি পারেন, আপনার বাম পাশে কাঁত হয়ে স্থিরভাবে  বিশ্রাম নিন । যতবেশি নড়াচড়া করবেন তত বিষ শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে
  • শরীরে কোন গয়না বা ঘড়ি থাকলে সরিয়ে ফেলুন, কারণ শরীর ফুলে গেলে এগুলো খোলা বেশ কঠিন হয়ে যাবে।
  •  সাবান জল দিয়ে ক্ষতস্থানটা ধুয়ে ফেলা
  •  শরীরের যে অংশে সাপ কমড়েছে সেটা যতটা সম্ভব স্থির করে রাখা। 
  •  ক্ষতস্থানটা পরিস্কার কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা।
  •  সাপ যেখানে কামড়েছে তার দুই থেকে চার ইঞ্চি উঁচুতে (অর্থাৎ হৃদ্পিণ্ডের দিকে) একটা জড়ানো ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। ব্যাণ্ডেজটা খুব কষে বাঁধা যেন না হয়, সেক্ষেত্রে রক্ত-চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। মোটামুটি ভাবে ব্যাণ্ডেজের তলা দিয়ে যাতে একটা আঙুল গলিয়ে দেওয়া যায় – সেটা দেখতে হবে।
  •  কোন সাপ কামড়েছে, সেটা জানা দরকার। কিন্তু সাপ ধরার চেষ্টা করার দরকার নেই। সম্ভব হলে মোবাইলে ছবি তুলে বা ভিডিও করে রাখতে পারেন।  সাধারণতঃ চিকিৎসকরা অ্যাণ্টিভেনম (সাপের বিষের প্রতিরোধক) ব্যবহার করেন। দুরকমের অ্যাণ্টিভেনম এখন পাওয়া যায়। এগুলি ব্যবহার করলে কিছু কিছু লোকের বিরূপ প্রতিক্রিয়াও হয়, সেইজন্য ডাক্তারদের এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।

 

সাপের কামড়ের পর কী করা উচিত নয় ?

সাপের কামড়ে মানুষ আতঙ্ক এবং ভয়ের কারনে অনেক ভুল জিনিস করতে পারে যা ক্ষতির কারন হতে পারে। এজন্য নিচের কাজগুলো কোনভাবেই করবেন না:

  • সাপটিকে ধরার চেষ্টা করবেন না বা এটিকে মারার চেষ্টা করবেন না, কারণ এটি আবার কামড় দিতে পারে। এমনকি মৃত সাপও কামড়াতে পারে
  • কোন ভাবেই রোগীকে ঝারফুক, কবিরাজী, ওঝা এদের কাছে নেয়ে যাবেন না। নিয়ে গেলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
  • কামড়ের উপরে বা নিচে খুব শক্ত করে বাধবেন না
  • ক্ষতস্থানে ব্লেড বা চাকু দিয়ে কাটবেন না
  • মুখ দিয়ে চুসে বিষ বের করার চেষ্টা করবেন না
  • বরফ লাগাবেন না
  • ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় পান করবেন না
  • কোনো ব্যথা উপশমকারী ওষুধ (যেমন ibuprofen) গ্রহণ করবেন না। 

 

কিভাবে সাপের কামড় চিকিৎসা করা হয়?

সাপের কামড়ের চূড়ান্ত চিকিত্সা হল অ্যান্টিভেনম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কামড়ের অ্যান্টিভেন নেয়ার চেষ্টা করুন। 

বাংলাদেশে সাপে কামড় দিলে নিকঠস্থ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিবেন। সেখানে চিকিৎসকদের এ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকে। 

সাপের আকার, রঙ এবং আকৃতি এবং রোগীর অবস্থা দেখে ডাক্তার কোন অ্যান্টিভেনম দিবেন তা নির্ধারণ করবেন

এন্টিভেনম ছাড়াও আরো বেশ কিছু ঔষুধ দেয়া প্রয়োজন হয়।

হাসপাতালে চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে অতিরিক্ত লোক নিয়ে ভীড় করবেন না।

এন্টিভেনম নেয়ার পরও অনেক ধরনের জটিলতা হতে পারে। 

সর্বাবস্থায় চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলুন।

 

সাপের কামড় থেকে কিভাবে বেঁচে থাকবেন?

সাপ নজরে পড়লে সেটির থেকে দূরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। 

সাপকে মারতে গিয়ে অনেকে সাপের কামড় খান। 

উঁচু উঁচু ঘাস বা জঙ্গলের মধ্যে না হাঁটাই শ্রেয়

যে জায়গাটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে হাত বা পা-ঢোকানো অনুচিত যেমন কোন গর্তে। মাছ ধরতে অনেকে পানির নিচে গর্তে হাত ঢুকান যা সাপের কামড়ের কারন হতে পারে। 

মাটি থেকে পাথর বা কাঠ তুলবার সময় জায়গাটা ভালোভাবে পরীক্ষা করে নেওয়া দরকার, যে নিচে সাপ লুকিয়ে আছে কিনা

গ্রামে রাতের অন্ধকারে হাঁটার সময়ে জোরে জোরে পা দাপিয়ে বা হাত তালি দিয়ে হাটতে হবে। টর্চ-বাতি (ফ্ল্যাশলাইট) ব্যবহার না করে অন্ধকারে পথ হাঁটা উচিত নয়

বন্যার সময় ঘরের ভিতর সাপ ঢুকে পড়তে পারে। এজন্য খুব সতর্ক থাকতে হবে।

ফ্লোরে ঘুমাতে হলে মশারি দিয়ে ঘুমানো ভালো। যেসব এলাকায় বাড়ির আশেপাশে সাপ বেশি দেখা যায় সেখানে সবসময় মাশারি ব্যবহার করা ভালো। 

ঘরের ভিতর হাস-মুরগির ঘর না রাখা ভালো। এগুলো ঘরের বাইরে রাখতে পারলে ভালো। 

হঠাত করে সাপের মুখোমুখি হলে শান্ত থাকুন। আস্তে করে তাদের সামনে থেকে চলে যান। কোনভাবেই তাদের দিকে হঠাত করে যাওয়া শুরু করবেন না। সাপ ভয় পেলে বেশি এগ্রেসিভ হয়ে যায়।

 

 

 

আমাদের প্রতিটি লিখা চিকিৎসক দ্বারা লিখিত ও সম্পাদিত। এই ওয়েবসাইটে চিকিৎসক বলতে নুন্যতম এম বি বি এস ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের বোঝানো হয়। এই ওয়েবসাইটের সকল লেখা সচেতনতামূলক এবং চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়